ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনা: তিন দিন পর বাবার কোলে রবিউল

বাসায় কাউকে না বলে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ঘুরতে এসে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হয় ১২ বছর বয়সের শিশু রবিউল। উদ্ধার করার পর দ্রুত ভর্তি করা হয় ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দুর্ঘটনায় যারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন একে একে সবাই স্বজনদের দেখা পেলেও, দেখা পায়নি রবিউল। তার স্বজনদের খুঁজে পেতে বহু মাধ্যম ব্যবহার করে প্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

অবশেষে তিন দিন পর বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) সকালে বাবার দেখা পেলো রবিউল। বাবার কোলে উঠে সে যেন এক শান্তির পরশ খুঁজে পেলো। যদিও গত রাতেই রবিউল তার বাবার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেছে। কিন্তু আজ সকালে ছিল হাসপাতালজুড়ে এক আবেগঘন পরিবেশ।

রবিউলের বাবা মিলন মিয়া বলেন, ‘রবিউলের মা দুই বছর আগে মারা গেছেন। তার তিন ছেলে। রবিউল তাদের মধ্যে দ্বিতীয়। মিরপুরে একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন তিনি। আর পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ঢাকার মিরপুরের শাহ আলী মাজার এলাকায়। ছেলেকে হারানো সম্পর্কে তিনি বলেন, সোমবার (২৩ অক্টোবর) সকালে কাউকে কোনও কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ছেলের সন্ধানে অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি। থানায় গিয়েছি। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাইনি। রবিউল ট্রেনে কোথাও যেতে পারে, এটা আমার ধারণা ছিল না। ফলে দুর্ঘটনার খবর জানা থাকলেও এই নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা কাজ করেনি। শেষে পুলিশের মাধ্যমে ছেলের সন্ধান পেয়ে আজ সকালে এসে আমার ছেলেকে কোলে তুলে নিলাম।’

এদিকে, বাবাকে কাছে পেয়ে মনের যত ভয় সব যেন নিমিষেই পালিয়ে গেছে রবিউলের কাছ থেকে। এখন তার কথাবার্তা আর আগের মতো এলোমেলো নেই। সবই ঠিক আছে। রবিউল ভৈরব কীভাবে পৌঁছালো সে বিষয়ে জানায়, সোমবার (২৩ অক্টোবর) তার এক বন্ধুর সঙ্গে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে ভৈরবে পৌঁছায়। ভেবেছিল ভৈরবে ঘোরাফেরা শেষে আবার ঢাকা চলে যাবে। তাই ফিরে যেতে ভৈরব থেকে এগারসিন্ধুর ট্রেনেও ওঠে। সে ট্রেনের পেছনের আগের বগিতে উঠেছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার পর সে তার বন্ধুকেও হারিয়ে ফেলে। তাই ভয়ে সঠিকভাবে কিছুই বলতে পারছিল না।

দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে রবিউলের সন্ধানে সংবাদ প্রকাশ হয়। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার পরিবারের সন্ধান পেতে ছবিসহ পোস্ট করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনও সাড়া মেলেনি। এভাবে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে রবিউলের কেটে যায় তিনটি দিন। আর এরই মধ্যে রবিউল কিছুটা সুস্থ হলেও কথা বলেছে এলোমেলো। নিজের নাম বলতে পারলেও আর কিছু সঠিকভাবে বলতে পারছিল না। তাই তাকে শান্ত রাখতে চিকিৎসকরা ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িতে রাখতেন।

ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘গত রাতেই আমরা রবিউলের বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। আজ সকালে সকল তথ্য প্রমাণাদি যাচাইয়ের ভিত্তিতে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রিফফাত জাহান, হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের উপস্থিতিতে তার বাবা মিলন মিয়ার হাতে রবিউলকে তুলে দিয়েছি। আমরা খুব খুশি ও আনন্দিত রবিউল তার বাবাকে খুঁজে পেয়েছে। পাশাপাশি কিছুটা আবেগাপ্লুত গত তিন দিনে রবিউলকে সবাই যেভাবে আগলে রেখেছে ও আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছিল।’

প্রসঙ্গত, গত সোমবার (২৩ অক্টোবর) বিকালে ভৈরব রেলস্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের দুই বগির সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যু হয়। পরে ঢাকা পিজি হাসপাতালে আরও একজনে মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মোট ১৮ জনের মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক।