ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য খুলনা অঞ্চলের শীর্ষ সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়াকে ভাড়া করা হয়। সে চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা। তবে গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে শিমুল ভূঁইয়া নিজেকে আমানুল্লাহ আমান নামে পরিচয় দিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে তাকে চিনতে পেরেছেন এলাকার মানুষ ও স্বজনরা।
এলাকার মানুষ ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তার নাম শিমুল ভূঁইয়া কিংবা আমানুল্লাহ আমান নয়; মাহমুদ হাসান শিমুল। ৯০ দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই নামেই পরিচিত ছিল। এরপর হত্যা মামলায় কারাগারে পাঠায় পুলিশ। কারাগারে থাকা অবস্থায় নিজেকে শিমুল ভূঁইয়া নামে পরিচিত করে তোলে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক। ফুলতলার দামোদর ইউনিয়নে তার বাড়ি। এই বাড়িতে স্ত্রী থাকতেন। বেশিরভাগই সময় কারাগারে ও আত্মগোপনে ছিল শিমুল।
স্থানীয় একাধিক রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুলনা অঞ্চলে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ হত্যার মাস্টারমাইন্ড মাহমুদ হাসান শিমুল। অপরাধজগতে আতঙ্কের নাম। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্যে কার্যক্রম না থাকলেও আঞ্চলিক নেতা শিমুল নাম বদলে দলের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। বছরের পর বছর ধরে সংগঠিত করেছে মতাদর্শীদের। টাকায় ‘ভাড়াটে খুনির গ্রুপ’ তৈরি করে একাধিক কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করেছে। তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তা এখন খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য। শিমুলের ভাই শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া শিপলু দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। ২০০৯-১০ সালে তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) দুপুরে শিমুলের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়িটি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। দুজন প্রতিবেশী বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, বেশিরভাগ সময় বাড়িটি তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকে। স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মাঝেমধ্যে বাড়িতে এসে থাকতেন। তবে শিমুলকে তারা বাড়িতে থাকতে দেখেননি।
মামার হাত ধরে চরমপন্থি
‘নকশাল আন্দোলন’ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের নাম। দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর আগে শিমুলের মামা আব্দুল হক ছিলেন এই অঞ্চলের নকশাল আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ফুলতলায় অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালাতেন। তারই ধারাবাহিকতায় শিমুল ও তার পরিবারের সদস্যরা নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হন। সেখান থেকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয় শিমুল। ১৪ বছর বয়সে প্রথম অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়।
স্থানীয় সূত্র ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গণেশ নামের এক ব্যক্তিকে খুন করে যশোরের অভয়নগর থানার এক মামলায় ১৯৯১ থেকে ৯৭ সাল পর্যন্ত সাত বছর কারাগারে ছিল শিমুল। ইমান আলী নামের এক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিল। কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০০৩ সালে শিমুলের ভাই মুকুল পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। ২০১৪ সালে কারামুক্ত হয়। এরপর থেকে এলাকার বাইরে ছিল। মাঝেমধ্যে গোপনে এলাকায় গেলেও কারও চোখে পড়েনি। বেশিরভাগ সময় আত্মগোপনে ছিল। তাকে যে ভাড়া করেছে, সেই আক্তারুজ্জামান শাহিন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা ডা. মিজানুর রহমান টুটুলের আত্মীয়। মিজানুর ২০০৮ সালে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। শিমুলের বিরুদ্ধে খুনসহ অন্তত দুই ডজন মামলা আছে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে ছিল।
শিমুলের একান্ত সহযোগী বিটু ২০০০ সালের জুনে গ্রেফতার হয়েছিল। সে সময় শিমুলের অপরাধ জগতের তথ্য দিয়ে বিটু রিমান্ডে পুলিশকে জানিয়েছিল, দামোদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেম, শ্রীফলতলা ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন হাওলাদার, নৈহাটি ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম রসুল হাওলাদার, যুবলীগ নেতা শাহাজাহান, সাইফুল ইসলাম, ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম, নিজ দলের নেতা গণেশ, অভয়নগরের ইউপি সদস্য মমতাজ উদ্দিনকে কীভাবে শিমুলের নেতৃত্বে হত্যা করা হয়েছিল।
ফুলতলা থানা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ফুলতলা উপজেলা যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম খোকনকে গুলির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় শিমুলকে রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ। তখন স্বীকার করেছিল একে-৫৬ অস্ত্র আছে তার পার্টির সদস্যদের কাছে। তখন ঢাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ টিম খুলনায় এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। সে সময়ে খুলনা অঞ্চলে চরমপন্থিদের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিল। আমানুল্লাহ নামে এক চরমপন্থি নেতা শিমুলের অন্যতম সহযোগী ছিল। পরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।
এমপি আনার হত্যার পর তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, শিমুল নিজেকে আমানুল্লাহ বলে পরিচয় দিয়েছে। আমানুল্লাহ নামেই পাসপোর্ট বানিয়েছে, সেই পাসপোর্টে কলকাতায় গিয়েছিল। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পাসপোর্টটি করা হয়েছিল।
ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শিমুল ভূঁইয়া পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির ছবিটি ফুলতলার মাহমুদ হাসান শিমুলের এক স্বজনকে দেখান বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই স্বজন বলেন, ‘তার নাম শিমুল ভূঁইয়া কিংবা আমানুল্লাহ নয়; মাহমুদ হাসান শিমুলই। কিন্তু সে কখনও আমানুল্লাহ নাম ব্যবহার করতো না। পরিবারের সবাই এবং আত্মীয়-স্বজন তাকে মাহমুদ হাসান শিমুল নামেই চেনে।’
দামোদর ইউনিয়নের বাসিন্দা তুহিন শেখ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তাকে শিমুল নামেই আমরা চিনি। কখনও আমানুল্লাহ নাম শুনিনি। ছবি দেখেই চিনতে পেরেছি, সে শিমুল। চরমপন্থি নেতা। এখনও তার নাম শুনলে আমরা আতঙ্কিত হই। এত বড় হত্যাকাণ্ডের কথা শোনার পর থেকে সবাই আতঙ্কে আছে।’
শিমুলের প্রতিবেশী দামোদর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) সুমন মোল্লা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৫০ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করছি। বর্তমানে এলাকার মেম্বার। শিমুলের নাম আমানুল্লাহ এই প্রথম শুনলাম। এলাকার সবাই তাকে শিমুল নামেই চেনে। আমানুল্লাহ তার সহযোগী ছিল। হয়তো তার মৃত্যুর পর নিজেকে বাঁচাতে আমানুল্লাহ নাম ধারণ করে পাসপোর্ট বানিয়েছে। সেইসঙ্গে নানা অপরাধ করেছে।’
শিমুলের অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিমুল ভূঁইয়া নামের বিষয়টি আমাদের কাছে এখনও ধোঁয়াশার। ২০১৪ সালের পর থেকে কখনও গ্রেফতার হয়নি। তবে স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনেছি, আমানুল্লাহ পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিই শিমুল। আমাদের কাছে এখনও কোনও সংস্থা এ বিষয়ে জানতে চায়নি, এটি জাতীয় ইস্যু। ডিবি এবং অন্যান্য সংস্থা তদন্ত করছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি না। আমাদের বললে তখন তদন্ত করবো।’