চাকিরপশার খাল দখলমুক্ত ও পুনর্খনন কাজ শুরু

দীর্ঘ আন্দোলনের পর কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার খাল দখলমুক্ত ও পুনর্খনন কাজ (প্রথম দফা) শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (৪ মে) উপজেলার বোতলার পাড় বটতলা বাজার এলাকায় নদীর উজানমুখে এ খনন কাজ শুরু হয়। রংপুর অঞ্চলে ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন ও সেচ দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এ খনন কাজ শুরু করে।

ঐতিহ্যবাহী ও বহুল আলোচিত এ খাল পুনর্খননের খবরে ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড় জমে। চাকিরপশার খালের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা পুনর্খননে প্রায় ২৫ হাজার একর জমির জলাবদ্ধতা দূর হওয়ার সম্ভবনা বাস্তবে রূপ নেওয়ার সূচনালগ্নে উপস্থিত কৃষকদের চোখেমুখে স্বস্তির ছায়া নেমে আসে। তারা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান।

বোতলার পাড় গ্রামের বাসিন্দা মতিয়ার রহমান বলেন, ‘এই নদী (স্থানীয়রা এই খালকে নদী বলেন) খননে দেবিচরণ, পুঁটিকাটা, দিনা, নাটুয়া মহল, নাফাডাঙ্গাসহ ১০টি মৌজার প্রায় ৫০ হাজার বাসিন্দা সরাসরি উপকৃত হবেন। সর্বশেষ প্রায় ৩০ বছর আগে এই নদী খনন করা হলেও কালের বিবর্তনে দখলদারদের কুনজরে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।’

দীর্ঘ আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে চাকিরপশার নদী (খাল) সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফ বলেন, ‘প্রথমে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে স্বারকলিপি দেওয়া হয়, তারপর জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের কাছেও স্বারকলিপি প্রদান করা হয়। নদীর উৎসমুখে ইটাকুড়ির দোলায় প্রায় ২৫ হাজার একর জমি আছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণে যেখানে বছরে একবার ধান আবাদ হতো। এই খাল খনন হলে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহের ফলে জলাবদ্ধতা দূর হয়ে এখন প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ ধান উৎপাদন সম্ভব।’ প্রায় ১২২ জন দখলদারের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া খাল পুনরুদ্ধার আন্দোলনটি বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সফল হতে চলেছে বলেও জানান তিনি।

চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়ক, নদী গবেষক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘আজ থেকে প্রায় ৩৫-৪০ বছর আগে এটি ভাটিতে বুড়ি তিস্তা এবং উলিপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতো। এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার। উলিপুরের থেতরাই নামক জায়গায় তিস্তা নদী এই নদীর ভেতর ঢুকে যাওয়ার কারণে নদীটি দ্বিখণ্ডিত হয়। ইটাকুরি নামক জায়গা থেকে উলিপুরের থেতরাই পর্যন্ত নদীটির দৈর্ঘ্য এখন প্রায় ২০ কিলোমিটার। এই দৈর্ঘ্যে নদীর অনেক জায়গায় পানি বাধাগ্রস্ত হয় এবং এই অঞ্চলের প্রায় ৮-১০টি মৌজার ২৫ হাজার একর জমির ধানের আবাদ বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়াও এই নদীর তিন-চার কিলোমিটার ভেতরে সাধারণ জেলেরা মাছ ধরতে পারে না।’ খনন কাজ শুরুর ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ সৃষ্টি হয়ে জলাবদ্ধতা দূর হবে এবং মানুষ তাদের জমিতে ফসল ফলানোর পাশাপাশি নদীটি তার প্রাণ খুঁজে পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই নদী গবেষক।

দীর্ঘ আন্দোলনে অনেক প্রতিকূলতা থাকলেও সেসব ভুলে গিয়ে সফলতার আনন্দকে স্মরণে রাখতে চান জানিয়ে এই নদী গবেষক বলেন, ‘এই অঞ্চলের মানুষের কাছে আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। আজ থেকে এখানকার পানি নেমে যাওয়ার একটি পথ তৈরি হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে হাজার হাজার কিলোমিটার নদ-নদী ও খাল বিল খননের কাজকে বিশেষ দৃষ্টিতে নিয়েছেন। বিএডিসি এই খাল খননে যে প্রকল্প নিয়েছে আমরা আশা করছি, তা মানসম্পন্ন হবে এবং এই কৃষি ও জীববৈচিত্র্য উপকৃত হবে।’

প্রায় ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই কিলোমিটার এই নদী খনন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে বিএডিসি। উপজেলার সদর ইউনিয়নের ইটাকুড়ির দোলা সংলগ্ন আঙ্গাধোয়ার ব্রিজ থেকে দক্ষিণ দিকে একই ইউনিয়নের নলাডাঙার ব্রিজ পর্যন্ত সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করা হবে বলে জানান খনন কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

খননকাজ উদ্বোধনের সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রাজারহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদ ইকবাল সোহরাওয়ার্দী, ভাইস চেয়ারম্যান আশিকুর রহমান মণ্ডল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির নেতাকর্মী ও স্থানীয় লোকজন।