৭১ এর দুঃসাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই সরকার বীরপ্রতীক

৭১এ ষোল বছরের তরুণ। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সশরীরে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন। ২৫ মার্চ ভয়াল কালো রাত্রির পর দেশ মাতৃকার টানে যুদ্ধ করার অনুমতি নিতে বাবা-মার কাছে ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে ফেরেন নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম সদরের মোঘলবাসায়। বাবা-মা হাসিমুখে অনুমতি দেন দেশ মাতাকে বাঁচাতে যুদ্ধে যেতে।

১৫ এপ্রিল ভুরুঙ্গামারীর কলেজ মাঠে উপস্থিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে অংশ নেন। এরপর বাড়িতে ফিরেছেন দেশ স্বাধীন করেই। ৬ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন বীরত্বের সঙ্গে। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাই সরকার বীর প্রতীক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।

বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপরত আব্দুল হাই সরকার

বীর প্রতীক আবব্দুল হাই সরকার জানান, মুক্তিযুদ্ধকালে অর্ধশতাধিক অপারেশনে অংশ নেন তিনি। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২টি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন আর গেরিলা যুদ্ধ করেছেন ৫০টিরও বেশি। প্রতিটি অপারেশন করেছেন জীবন বাজি রেখে। একবার নাগেশ্বরী এলাকার নাখারগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া মর্টার সেলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হন তিনি। দুই হাত ও দুই পায়ে আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তাতেও পিছপা হননি। সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে নেমে পড়েন। এখনও বাম হাতের দুটি আঙ্গুল বাঁকাতে পারেন না।

শহরের হালাবট এলাকায় মাইন ব্লাস্ট করে কুড়িগ্রাম থেকে চিলমারীগামী পাকিস্তানি বাহিনীকে বহনকারী ট্রেন লাইনচ্যুত করে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন এই কোম্পানি কমান্ডার বীর প্রতীক। সেদিন তার কোম্পানির এক সহযোদ্ধা শহীদ হলেও ট্রেন লাইনচ্যুত করে ৩/৪ জন পাকিস্তানি হানাদারকে হত্যা করেন তারা।

আরও কোনও স্মরণীয় অপারেশন, জানতে চাইলে নিজের স্মৃতি রোমন্থন করে এই বীর প্রতীক জানান, ৭১ এর ২৭ কিংবা ২৮ জুলাই তিনি তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে লালমনিরহাট এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ঘাঁটিতে হামলা চালান। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড গোলা বর্ষণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। এমন সময় তিনি হঠাৎ কাছের একটি ডোবার পানিতে পড়ে যান।

রাতের অন্ধকারে শুধু বন্দুকের গুলি ছোড়ার আলো দেখা যাচ্ছিল। তার কোমরে তখন দুইটি গ্রেনেড বাঁধা। বন্দুকের গুলি ছোড়ার আলো অনুসরণ করে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বাঙ্কারের কাছে চলে যান। এক হাতে গ্রেনেড আর অন্য হাত দিয়ে বাঙ্কারে রাখা একটি এলএমজির নল ধরে গ্রেনেডের পিন খুলে ছুড়ে মারেন বাঙ্কারের ভেতর। নিয়ে আসেন পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যবহৃত একটি লাইট মেশিনগান(এলএমজি)। পরবর্তীতে এই এলএমজি দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন।

এছাড়াও ভুরুঙ্গামারীর সোনাহাট রেল সেতু অপারেশনে অংশ নিয়ে সফলভাবে তা সম্পন্ন করেন। যদিও তাদের অপারেশনের পূর্বে আরও দু’বার এই অপারেশন ব্যর্থ হয়।

বিজয়ের কয়েক দিন আগে ২ ডিসেম্বর মোঘলবাসা এলাকায় ১৫০ জন রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সদস্য তার কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে।

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও  কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। ওই দিন কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে বিকেল ৪টায় নতুন শহরস্থ ওভারহেড পানির ট্যাংকের ওপর স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।

কুড়িগ্রামের আকাশে উড়ে বিজয়ের পতাকা।

আব্দুল হাই সরকার বীর প্রতীক জানান, যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক অস্ত্র তারা উদ্ধার করেছিলেন। এ কারণে তার দলের ৩৩৫ মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্রসহ যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়েছেন ১২১৩ টি।

সরকারের দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা এখন তার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস।

দশ ছেলে-মেয়ের জনক এই বীর প্রতীক দু’জন বীরঙ্গনাকেও নিজের জীবনসঙ্গী করেছিলেন। একজন মারা গেছেন আর একজন পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত ছেলেকে নিয়ে আলাদা থাকেন।

৬৩ বছর বয়সের এই বীর প্রতীকের এখন সময় কাটে স্ত্রী গুলশান আরা বেগমকে নিয়ে আর ধর্মকর্মের মধ্য দিয়ে। অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেন,‘সেদিন তরুণ ছিলাম বলেই যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আজ বড় আনন্দ হয় আমি দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি।’

দেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি? সর্বশেষ এই প্রশ্নের উত্তরে এই বীর যোদ্ধার সরল উত্তর, ‘সবার শান্তির জন্য একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হবে এটাই আমার স্বপ্ন।

/এইচকে/