তিন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার দুর্লভ ছবিটি শোভা পাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও ব্যানারসহ পাঠ্যবইয়ের গল্পের প্রচ্ছদে। কিন্তু দুর্লভ এই ছবির মানুষগুলো ও পরিবারের খোঁজ নিচ্ছে না কেউ। মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে খালেক, মজিদ ও মজিবর এই তিন জনের ছবিটি কালজয়ী।
ছবিতে থাকা তিন জনই টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন ইউনিয়নের মুশুরিয়া গ্রামের কিশোর। ওপরে গ্রেনেড ছুড়ছেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক। মাঝে রাইফেল হাতে আব্দুল মজিদ। বাঁয়ে রয়েছেন মজিবর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর গোধূলিলগ্নে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে পাক হানাদার বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটির বাংকার ধ্বংসের চিত্রটি ফ্রেমে আটকে রাখেন মানিকগঞ্জের নাইম উদ্দিন নামে এক ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধে এই তিন কিশোরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লেও ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি একটি দৈনিকে ছবিটি প্রকাশের পর স্বজনরা জানতে পারেন তারা বেঁচে আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খালেক, মজিদ ও মজিবর প্রায় সমবয়সী। তখন প্রায় ১২-১৩ বছরের কিশোর। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা প্রেরণা পান। ভাবেন যুদ্ধ সুনিশ্চিত। ২৫ মার্চের কালরাতে তারা বুঝতে পারেন যুদ্ধ সামনে। ২৬ মার্চ থেকে সংকল্প করেন দেশকে বাঁচাতে সংঘবদ্ধ হতে হবে। প্রথমে মনে করেন সেনাবাহিনী পারবে দেশকে মুক্ত করতে। অনিশ্চয়তা দেখে সমবয়সীদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন তারা।
মে’র শেষের দিকে তারা ২১ জন বন্ধু মিলে নৌকাযোগে ইন্ডিয়ার মাইনকার চরে চলে যান। তিন দিন পর তাদের মেডিক্যাল হয়। তুরা ক্যাম্পে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সেখানে আলফা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ২১ দিন ফ্রন্টফাইটার, অতঃপর সাত দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় ৭০০ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা দেশে ফেরেন। তাদের কৌশল ছিল, সুযোগ বুঝে শত্রুদের ওপর আকস্মিক হামলা, পরক্ষণেই ইন্ডিয়ায় আত্মগোপন করা। কিছু দিন পর সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে সম্মুখ যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী (ইন্ডিয়ান আর্মি ৬ বিহার) রেজিমেন্টের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামে। তবে তাদের বন্ধু তোফায়েল (তুলা মিয়া) মেডিক্যালে আনফিট হয়ে দেশে ফিরে পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নেন। শুধু পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ করেননি তারা, সাহসিকতার সঙ্গে ধ্বংস করেন শত্রুদের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি। তারই একটি প্রতিচ্ছবি আলোচিত এই ছবি।
তাদের একজনকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রিকশা চালাতে হয়েছে। আরেকজনকে কখনও কারখানার শ্রমিক কখনও নৌকার মাঝি হয়ে সংসার চালাতে হয়েছে। স্বাধীনতায় অগ্রণী ভূমিকায় নেই তাদের বাড়তি কোনও সম্মাননা। তিন জনের মধ্যে দুজন দীর্ঘ সময়ে পাননি সম্মানজনক কোনও উপার্জনের উৎস।
দুর্লভ ছবিতে থাকা আব্দুল খালেক তার বাড়িতে নিজ অর্থায়নে একটি জাদুঘর তৈরি করেছেন। সেখানে যত্নে রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় নিদর্শন। টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন সংগ্রহ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জাদুঘরে রেখেছেন তার গ্রামের ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধার ছবি। সাদাসিধা পোশাকে তিনিই যে ছবির মানুষটি তা অন্যকে বোঝাতে বেগ পেতে হয়।
সম্প্রতি ঢাকার খিলক্ষেতে ক্যান্টনমেন্টের সামনে এই ছবির ব্যয়বহুল ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে। তবে সেখানে আব্দুল খালেক ও আব্দুল মজিদের ভাস্কর্য থাকলেও নেই মজিবর রহমানের। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য তৈরি হলেও নিজের উপজেলা ও জেলার মানুষকে ছবি দেখিয়ে নিজের পরিচয় দিতে হয়। নেই কোনও প্রতীকী ভাস্কর্যও।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রায় আড়াইশ’ কবিতা লিখেছেন তিনি। অর্থের অভাবে প্রকাশ করা আর হয়ে ওঠেনি। তিনি গোগ্রীন অটবি লি.-এর গুলশান শাখার অ্যাম্বাসেডর পদে চাকরি করতেন। অটবির ব্যবসায়িক অবস্থা মন্দা থাকায় বেতন বকেয়া পড়ে। এই কারণে চাকরি ছেড়ে অবসরে চলে যান চট্টগ্রামে। পরে নিজ বাড়িতে চলে আসেন। খালেকের ঘরে রয়েছেন চার ছেলেমেয়ে। ছেলেরা পৃথক হওয়ায় সরকারি সম্মানী এখন তার একমাত্র উপার্জন।
আব্দুল খালেক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের সম্মানিত করেছেন। ঢাকার খিলক্ষেতসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে। তবে নিজ উপজেলা বা জেলায় কোনও ভাস্কর্য তৈরি করা হয়নি। নিজ উপজেলা ও জেলায় শহরে আমাদের ভাস্কর্য ও জাদুঘর তৈরির দাবি জানাই।’
আব্দুল মজিদ। তিনি ব্যাটালিয়ন আনসারে প্লাটুন কমান্ডার পদ থেকে অবসরে আসছেন। বাড়ির পুকুরে মাছ চাষ করে সময় কাটাচ্ছেন তিনি। তার তিন মেয়ে। অর্থের অভাবে মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করতে পারেননি। এই তিন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আব্দুল মজিদের পরিবার সবচেয়ে দরিদ্র।
মজিবর রহমান ২০১৪ সালে মারা যান। মজিবর রহমানের স্ত্রী সাহাতন বেগম জানান, ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মজিবর রহমান রেখে গেছেন চার ছেলে। আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবিকার জন্য রিকশা চালাতে হয়েছে মজিবর রহমানকে।
এদিকে, আলোচিত এই দুর্লভ ছবির ব্যক্তিদের বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করার দাবি জানান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের প্রত্যাশা, এই তিন মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য নির্মাণ হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিশেষ জায়গায় নাম লেখাতে পারবে টাঙ্গাইল জেলা।
দেলদুয়ার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবু তাহের বাবলু বলেন, ‘আলোচিত এই দুর্লভ ছবির তিন জনকে আমি চিনি। তারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের সম্মানে স্থানীয়ভাবে ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।’
উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মোবারক হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের জন্য একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুত কাজ শুরু হবে। তারা তিন মুক্তিযোদ্ধাই মাসিক সম্মানী নিয়মিত পাচ্ছেন।