হাওরের বির্স্তীণ জনপদ এখনও অথৈ পানিতে থৈ থৈ। পানির অপর নাম জীবন হলেও হাওরবাসীর কাছে তা এখন মরণ। যত দূর চোখ যাবে পানি আর পানি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন পানির ওপর কোনওরকমে ভেসে আছে এক টুকরো ভূখণ্ড। আর কাছে গেলে নজরে পড়বে দুঃখ, ভুখা-নাঙ্গা মানুষের দুঃস্বপ্ন যাপন।
হাওর ঘুরে দেখা গেছে, হাওরে ফসলডুবির পর দেখা দেয় মাছ ও হাঁসের মড়ক। খাদ্য সংকটে কৃষক অনেক আগেই পানির দামে গবাদিপশু বিক্রী করে দিয়েছেন। ঘরে সংসারের অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছু নেই, যা বিক্রি করে সংসার চালবেন। চারদিকে পানিবেষ্টিত গ্রামের স্যাঁতস্যাঁতে বসত ঘরে প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়ে পরিবার নিয়ে রাতের নিদ্রা, কেউ কেউ আবার হাওরে মাছ ধরার জন্য নৌকাতেই রাত্রি যাপন করেন।
জানা যায়, হাওরবাসীর পরিবারে গড়ে ৫ থেকে ৬ জন করে সদস্য রয়েছেন। প্রতিদিনের তিনবেলার খাদ্য চাহিদা পূরণে তাদের প্রয়োজন কমপক্ষে ৫ কেজি চাল। সরকার জেলার ১১০জন ডিলারের মাধ্যমে খোলাবাজারের প্রতিদিন ডিলার প্রতি ১ টন করে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করছে। একটন চাল ২০০ জনের চাহিদা পূরণ করতে পারে। বাকি জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে রয়েছে। যতদিন যাচ্ছে অভাবের তাড়না তত বাড়ছে। সংসারের খরচ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ মৌলিক চাহিদা তারা এখন আর পূরণ করতে পারছেন না। হাওরের পানিতে মাছ ধরার সুযোগ না পেয়ে আরও অসহায় অবস্থায় কাটাচ্ছেন দিন।
পিয়ারি নগর গ্রামের ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘সরকার বড়লোকের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় কিন্তু হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মুখে ভাত দিতে ওএমএস চালের পরিমাণ বাড়ায় না।’
মৎস্যজীবী নিবারণ দাস বলেন, ‘ঘরে ধান-চাল নাই, হাওরে মাছ ধইরা রোজগার কইরা সংসার চালানোর কথা ভাবছিলাম কিন্তু বাড়ির কাছেও মাছ ধরতে দেয় না ইজারাদারের লোকজন।’
তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার পাড়ের জয়পুর গ্রামের ইদন মিয়া জানান, হাওরে মাছ ধরলে আনসাররা তাদের জাল-নৌকা নিয়ে যায়। মাছের জীবনের দাম বেশি না মানুষের জীবনের দাম বেশি বলেও প্রশ্ন রাখেন তিনি সরকারের কাছে।
ছদরুল আমিন বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে পাহারাদারদের চাহিদা মতো টেকা দিলে মাছ ধরা যায় আর না দিলে ধরা যায় না। যুগের পর যুগ হাওরের মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে, কিন্তু সরকার মাছ ধরা নিষেধ করে টাঙ্গুয়ার মানুষদের না খেয়ে মরার বন্দোবস্ত করে দিছে।’
ছিলাইন তাহিরপুর গ্রামের বুরহান উদ্দিন বলেন, ‘হাওরের মাছ ধরা নিষেধ থাকায় হাওরের মৎস্যজীবী ও তাদের পরিবার পরিজনের উপোস থাকার ব্যবস্থা করছে সরকার।’
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ‘উন্মুক্ত জলাশয়ে জেলেরা মাছ ধরতে না পারলে জেলেরা দুর্ভিক্ষে মধ্যে পড়বে।’ তিনিও সরকারের প্রতি জেলেদের মাছ ধরার সুযোগ দেওয়ার কথা বলেন।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, ‘ইজারাকৃত জলমহালের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে প্রশাসন। সেখানে জেলেরা মাছ ধরতে পারবে না। কিন্তু ভাসান পানিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের অধিকার জেলেদের রয়েছে এটি নিশ্চিত করতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক ত্রুটির কথা শোনা যায়। এগুলো দূর করে হাওরপাড়ের মৎস্যজীবীদের কল্যাণে বৈধভাবে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।
সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সাংসদ সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম.এ মান্নান বলেন, ‘হাওরের ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার সব মৎস্যজীবীদের রয়েছে। ভাসান পানিতে মাছ ধরতে বাধা দেওয়ার কোনও অধিকার কারও নেই। কেউ বাধা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি জেলা প্রশাসন ও মৎস্য অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করবো।’
ছবি: হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
আরও পড়ুন: অনাহার-হাহাকারে কেটে গেল হাওরবাসীর ঈদ
/এমও/