শতবর্ষের চন্দ্রনাথ পুকুর ভরাট করে নির্মাণ হবে মার্কেট

হবিগঞ্জ শহরকে এক সময় ‘পুকুরের শহর’ বলা হতো। শহর ও আশপাশের এলাকায় পুকুরই ছিল খাবার পানির উৎস। দখল, ভরাট, দূষণ ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে অনেক পুকুর। এবার হবিগঞ্জ শহরে ঐতিহ্যবাহী চন্দ্রনাথ পুকুর ভরাট করে বহুতল মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে হবিগঞ্জ পৌরসভা। 

জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর বিধান অনুযায়ী, যেকোনও জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ। তারপরও শত বছরের পুরনো পুকুর ভরাট করে মার্কেট তৈরির উদ্যোগ নেওয়ায় জনমনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) সরেজমিন দেখা যায়, শহরের প্রাণকেন্দ্র টাউন মসজিদ রোড এলাকায় একটি দোকান সরিয়ে পুকুর ভরাট শুরু হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক টুকরি দিয়ে বালু পুকুরে ফেলছেন। চার দিন ধরে পুকুর ভরাট কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

চার দিন ধরে চলছে ‍পুকুর ভরাটের কাজ

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাফেজ ফজলুল হক নামে এক দোকান মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দোকানটি সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর সেখান দিয়ে পুকুরে বালু ভরাট শুরু করেছে পৌরসভা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার এক কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আতাউর রহমান সেলিম পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর চন্দ্রনাথ পুকুর পাড়ের ১৯ জন দোকান মালিককে নিয়ে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি পুকুরটি ভরাট করে বহুতল মার্কেট করার কথা জানান।

স্থানীয়রা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে প্রধান সড়ক ও আশপাশ এলাকার পানি পৌরসভার ড্রেনের পাশপাশি এই পুকুরটিতেও যথেষ্ট নিষ্কাশন হয়। পুকুরটি ভরাট করা হলে বৃষ্টির পানি জমে দোকান ও আশপাশের বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া এই পুকুরের পানি ওই এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ কাজেও ব্যবহার করা হয়।

ব্যবসায়ী শংকর কুমার অধিকারী জানান, মাস্টার কোয়ার্টারে জমিদার গোষ্টবাবুর দালান (বর্তমানে সমবায় ব্যাংক), তার পূর্বপুরুষের নামে চন্দ্রনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই শত বছরের পুরনো চন্দ্রনাথ পুকুর। গোষ্টবাবুর বাড়ি ছিল শহরতলীর মাছুলিয়া গ্রামে।

হবিগঞ্জের প্রবীণ সাংবাদিক মনসুর উদ্দিন ইকবাল ও মাস্টার কোয়ার্টার এলাকার কয়েকজন জানান, এই পুকুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট বোন খাদিজা হোসেনের পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত। ষাটের দশকে তার স্বামী সাঈদ হোসেন পরিবার নিয়ে চন্দ্রনাথ পুকুর পাড়ে গোষ্টবাবুর দালানে থাকতেন। তিনি ওই সময়ে হবিগঞ্জ মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সে সময় পৌর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু না হওয়ায় টিউবওয়েল ও পুকুরই ছিল নিত্য ব্যবহার্য কাজের ভরসা। ওই সময়ে চন্দ্রনাথ পুকুরে মাস্টার কোয়াটার, মুসলিম কোয়ার্টার ও হাসপাতাল কোয়ার্টারের বাসিন্দারা গোসল করতেন।

বাপা’র নেতৃবৃন্দ শুক্রবার পুকুরটি পরিদর্শন করেন

এদিকে পুকুর ভরাটের খবর পেয়ে শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল সংগঠনের স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে পুকুরটি পরিদর্শন করেন।

পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হবিগঞ্জ একসময় পুকুরের শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। গত কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকটি পুকুর ভরাট করে ফেলায় শহরে জলাবদ্ধতা ও ভূগর্ভস্থ পানি সংকট দেখা দিয়েছে। হবিগঞ্জ পৌরসভা শতবছরের পুরনো চন্দ্রনাথ পুকুর ভরাটের উদ্যোগ নিন্দনীয়, একই সঙ্গে বেআইনি। দেশের সকল পৌর এলাকার পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাধার পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের আইন ও নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এই প্রকল্পে ঘিরে দৃষ্টিনন্দন জনকল্যাণকর উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

এই পুকুরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত। তাই অবিলম্বে ভরাট কাজ বন্ধ করে পুকুরটি পুনরুদ্ধারের ও যথার্থ সংরক্ষণের দাবি জানান শরীফ জামিল।

হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আতাউর রহমান সেলিম বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। পৌর সচিব মো. ফয়েজ আহমেদ মাটি ভরাটের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এর দায়িত্ব কমিশনার শাহ সালাউদ্দিন আহম্মদ টিটুকে দেওয়া হয়েছে। তিনি সব তথ্য দিতে পারবেন। তবে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করে তার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

পৌরসভার প্যানেল মেয়র গৌতম কুমার রায় জানান, ২-৩ মাস আগে মেয়র আতাউর রহমান সেলিমের সভাপতিত্বে পৌর পরিষদের এক সভায় চন্দ্রনাথ পুকুরটি ভরাট করে বহুতল মার্কেট করার সিদ্ধান্ত হয়।

জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, জলাশয় ভরাটের কোনও সুযোগ নেই। সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী যদি চন্দ্রনাথ পুকুরটি জলাশয় হিসেবে উল্লেখ থাকে, অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।