সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তির কয়েক দিন পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় সালেহা খাতুনকে (৪৮)। পড়াশোনার ইতি টেনে চলে আসতে হয় স্বামীর গৃহে। বাল্য বিয়ের শিকার সালেহা খাতুন লেখাপড়ার ইতি টানাকে মেনে নিতে পারেননি। ভেতরে ভেতরে যুদ্ধ চালিয়ে যান। সংসারের ঝামেলা কিছুটা কমিয়ে শুরু করেন লেখাপড়া।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের তক্তপাড়া গ্রামের গৃহবধূ তিনি। মাধ্যমিক পাস করার পর এবার বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ কারিগরি অ্যান্ড ব্যবস্থাপনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন অদম্য ইচ্ছা শক্তির এই নারী।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে এসেছেন সালেহা। আর কেন্দ্রের বাইরে মাকে নিয়ে যাওয়া জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তার বড় ছেলে সদ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে পাস করা শামীম হোসেন। তিনি আবার বাগমারা ছাত্র প্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য।
সালেহা খাতুনের বড় ছেলে শামীম হোসেন বলেন, আমার মাকে কেন্দ্র থেকে নিয়ে আসা যাওয়া করছি। এক সময় আমার মা ও বাবাও আমাদের জন্য করছিলেন। আমাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য মায়ের অবদান বেশি। এই বয়সে মায়ের লেখাপড়ার প্রতি টান ও ধৈর্য দেখে অবাক হয়েছি। মায়ের জন্য গর্ব করি।
পরীক্ষার্থী সালেহা খাতুন জানান, লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে শুরু করেছেন। স্বামী ও সন্তানেরা সহযোগিতায় গত ২০১৯ সালে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন উপজেলার শ্রীপুর রামনগর টেকনিক্যাল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের ভোক শাখায়। সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক পাস করার পর ভর্তি হন উপজেলা সদর ভবানীগঞ্জ কারিগরি অ্যান্ড ব্যবস্থাপনা কলেজে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষার অংশ নিয়েছেন গত ২৬ জুন থেকে। পরীক্ষা ভালো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নিজের গল্প শোনান সালেহা খাতুন। তার বাবার বাড়ি উপজেলার হামিরকুৎসা ইউনিয়নের অর্জুনপাড়া গ্রামে। বাবা আবদুস সাত্তার ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য।
সালেহা খাতুন আরও বলেন, এলাকার একটি বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়। যদিও এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। তবে পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে পুরোদমে ঘর-সংসার শুরু করি। এর মধ্যে সন্তানের মা হই।
জানা গেছে, স্বামী ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার। বড় ছেলে শামীম হোসেন এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে সম্মান এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ছোট ছেলে সাগর হোসেন রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজে সম্মান শ্রেণিতে পড়ছেন।
সালেহা খাতুন জানান, সংসারের চাপ কমে আসার কারণে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। স্বামী-সন্তানেরা তাকে সহযোগিতা করেন লেখাপড়ায়।
এই বয়সে নিজের লেখাপড়ার আগ্রহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে চার জনই শিক্ষিত। তারা শিক্ষকতা পেশায় আছেন। আমি কেন পিছিয়ে থাকবো? যদি সুযোগ থাকে তাহলে স্নাতক শেষ করে এলএলবি পড়ে আইন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার ইচ্ছে আছে।
তিনি আরও জানান, তার লেখাপড়ায় স্বামী ও সন্তানেরা মানসিকভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহিত করেছেন।
তার স্বামী তক্তপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহা আলী বলেন, সালেহা খাতুনের মধ্যে অদম্য ইচ্ছা শক্তি দেখেছি। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ আছে। তাই ছেলেদের সুশিক্ষিত করার পর নিজে শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে সংসারের সব ঠিক রেখে লেখাপড়া করছেন।
ভবানীগঞ্জ কারিগরি অ্যান্ড ব্যবস্থাপনা কলেজের সহকারী অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম জানান, সালেহা খাতুন তার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। কক্ষে অন্যদের সঙ্গে বসে পরীক্ষা দিচ্ছেন। এই বয়সে তার যে আগ্রহ তা মুগ্ধ করেছে।