জমি অধিগ্রহণে নেই অগ্রগতি, ভাড়া ভবনে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম

দেশে নতুন প্রজন্মের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় সবারই কার্যক্রম চলছে ভাড়া করা ভবনে। বিভিন্ন কলেজের ভবনে নিয়েও চলছে ক্লাস। জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়নি বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের। আবার জমি পেলেও ভবন তৈরি করতে পারেনি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক ও ল্যাব সংকট নিয়ে শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কবে নাগাদ নিজস্ব ক্যাম্পাসে পুরোপুরিভাবে যেতে পারবে, তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ বলছে— সরকারি অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলে জমি অধিগ্রহণের পর নিজস্ব ক্যাম্পাসে ফিরতে বেশি সময় লাগবে না। আর বরাদ্দ পেলে ভবনও নির্মাণ হবে তাড়াতাড়ি। তারা বলছে, বিভিন্ন সংকট থাকার পরও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন নিয়ে। কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় আজও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভাড়া বাড়িতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে চাই না। কিন্তু অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়া বাড়িতেই শুরু হয়ে গেছে। নতুন যারা অনুমোদন পায়, তারা বলছে ভাড়া বাড়িতেই হোক। কারণ, জমি অধিগ্রহণ, অ্যাকাডেমিক প্ল্যান, মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা, ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা) তৈরি করতে অনেক বছর চলে যাবে। এগুলো যদি তাড়াতাড়ি করা যেতো, তাহলে শিক্ষা কার্যক্রম দুই-তিন বছরেই শুরু করা যেতো। কিন্তু আমার আসার আগেই (নিয়োগ পাওয়ার আগে) অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়া বাড়িতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। যদিও পর্যাপ্ত অর্থ নেই।  সে কারণে সরকারকে আমরা চাপ দিতে পারছি না। অর্থ বরাদ্দ করতে পারছি না। বৈশ্বিক কারণে দেশের অর্থনীতিতেও এখন চাপ পড়ছে। এখন তো সেই চাপ সামাল দিতে হচ্ছে।’

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস হয়নি আজও। ইউজিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চাঁদপুর পৌর এলাকার খলিসাঢুলিতে একটি কলেজে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করানোর প্রস্তুতি চলছে।

চাঁদপুর থেকে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি ইব্রাহীম রনি জানান, ভাড়া করা ভবনের প্রথম তলা থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ভবনে আসবাবপত্র সেটআপ ও বৈদ্যুতিক কাজ চলছে। স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে ৬২ একর জমি প্রস্তাব করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাছিম আখতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথমে ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। এরপর প্রথমবারের মতো তিনটি বিভাগের জন্য ১২ জন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। তবে অবশ্যই মার্চ থেকে আমরা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করবো।’

উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নিয়োগের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘এখনও তো আমারই দাঁড়ানোর জায়গা ঠিকঠাক হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনেক কষ্টে একটা জায়গা ঠিক করেছি। এ ধরনের পদে জনবল নিয়োগ দিলে তাদের অ্যাকোমোডেশন, গাড়ি, তাদের জন্য পিয়নসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

২০১৯ সালে শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। কিন্তু আজ অবধি জমি অধিগ্রহণ ও স্থায়ী ক্যাম্পাস হয়নি।

খুলনা থেকে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি হেদায়েৎ হোসেন মোল্লা জানান, গত চার বছর ধরে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম অস্থায়ী ক্যাম্পাসে পরিচালিত হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প প্রণয়ন, ৫০ বছর মেয়াদী মাস্টার প্ল্যান এবং বিভিন্ন ধরনের সার্ভে কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। প্রস্তাবিত ১৫০০ একর জমিতে ফিজিবিলিটি স্টাডি কার্যক্রম শেষ হয় ২০২১ সালে। পিসিআর রিপোর্টে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দাখিল করা ১৫০০ একর জমির পরিবর্তে ২৫০ একর জমিতে বিল পাবলা ও লতা পাহাড়পুর মৌজা থেকে জমি অধিগ্রহণের সুপারিশ করে।

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আবুল কাসেম চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের নতুন নিয়মের আওতায় এ বিশ্ববিদ্যালয় হবে ২৫০ একরের। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় শহরের গুরুদয়াল সরকারি কলেজের একটি নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনে গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে ক্লাস। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে— জায়গা নির্ধারণসহ সব কিছু আটকে আছে।’

বাংলা ট্রিবিউনের কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি বিজয় রায় খোকা জানান, ক্লাস শুরুর প্রথম দিন দুপুরে সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়— ক্যাম্পাসের মাঠ ঠিকঠাক করছেন শ্রমিকরা। ভবনের সামনের পুকুরে মাটি ফেলে পুকুরটি ছোট করা হচ্ছে। নির্মিত হচ্ছে একটি পাকা রাস্তাও। ১০ তলা ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি এখনও। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে পাঠদান।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. জে এম পারভেজ সাজ্জাদ জানান, শহরতলীর বৌলাই এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ১০৩.৮৭ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। অধিগ্রহণের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এর জন্য ১০৬ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনাও জমা দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণসহ সামগ্রিক অবকাঠামোগত কাজের প্রস্তাবটি বর্তমানে একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি

২০১৮ সালে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে ভাড়া করা ভবনে। গাজীপুরের কালিয়াকৈড় উপজেলা সদরে ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের পাশে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালটিতে বর্তমানে ৩৭৭ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন।

বাংলা ট্রিবিউনের গাজীপুর প্রতিনিধি রায়হানুল ইসলাম আকন্দ জানান, বিশবিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলেও শিক্ষক সংকট মেটানো সম্ভব হয়নি। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের যে নিজস্ব জায়গা  বা ভবন নেই। এ কারণে  শিক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে না। তবে আমাদের অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব আছে।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

২০১৮ সালের ১৭ এপ্রিল ৯ জন শিক্ষক ও ৩টি বিভাগে ১০৫ জন শিক্ষার্থী দিয়ে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়। বিগত পাঁচ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি।

বাংলা ট্রিবিউনের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি রানা আহমেদ জানান, অস্থায়ী ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলছে শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে অ্যাকাডেমিক ভবন-১, মাওলানা সাইফুদ্দিন ইয়াহিয়া ডিগ্রি কলেজে অ্যাকাডেমিক ভবন-২ এ। বঙ্গবন্ধু মহিলা ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। এছাড়া ভাড়া বাড়িতে চলছে প্রশাসনিক কার্যক্রম।

শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে পাঠদান হয় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত, বাংলা, অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের। মাওলানা সাইফউদ্দিন ইয়াহিয়া ডিগ্রি কলেজে হয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের ক্লাস।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শাহ্ আজম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্থায়ী ক্যাম্পাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়টি নানাভাবে অবহেলিত ছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। বছরে সরকারি যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক কম। নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্য প্রকল্প করা হয়েছে এবং সেটা ডিপিপি হয়েছে। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা রয়েছে। আশা করি, খুব দ্রুতই নিজস্ব ক্যাম্পাস পাবে বিশ্ববিদ্যালয়।

রাঙামাটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতিষ্ঠার ২১ বছরেও নিজস্ব ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু করতে পারেনি রাঙামাটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। নিজস্ব জমি থাকলেও শিক্ষা কার্যক্রম চলছে অস্থায়ী ভবনে। এছাড়া শিক্ষক সংকট তো রয়েছেই।

রাঙামাটি থেকে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি জিয়াউল হক জানান, ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় শহরে তবলছড়ি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে। বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যলয়টিতে কোনও ল্যাব নেই।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। পিডি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছি এক মাস আগে। দেড় মাস আগে নতুন রেজিস্ট্রার পেয়েছি। সামনে পিইসি’র মিটিং রয়েছে। যদি মন্ত্রণালয় চারটি প্রকল্পের মেয়াদ এক্সটেনশন করে ৩ থেকে ৪ বছর, তাহলে এই মেয়াদে প্রশাসনিক ভবন, অ্যাকাডিমক ভবন, ছাত্রদের একটি এবং ছাত্রীদের হল করা যাবে। এই প্রকল্পের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এরপর তিন বার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তখন আমি ছিলাম না। কিন্তু ৬ বছরেও শিক্ষক নিয়োগ হয়নি, প্রকল্প বাস্তবয়ন হয়নি।’

হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার গোপায়া ইউনিয়নের ভাদৈ এলাকায় দুটি ভবন ভাড়া নিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের মাধ্যমে অনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

হবিগঞ্জ থেকে বাংলা ট্রিবিউনের জেলা  প্রতিনিধি ছনি চৌধুরী জানান, বিশ্ববিদ্যলয়ের জন্য কোনও জমি বরাদ্দ হয়নি। স্থায়ী ক্যাম্পাসের জায়গা অধিগ্রহণের জন্য  মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এরইমধ্যে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আবদুল বাসেত বলেন, ‘চলতি বছর প্রথমবারের মতো শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভর্তি কার্যক্রম শেষে খুব দ্রুত পাঠদান শুরু হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যায়ক্রমে আবাসন, ল্যাব ও ক্যানটিনসহ সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা চালু করা হবে।’

আরও পড়ুন:

উপ-উপাচার্য-রেজিস্ট্রার-ট্রেজারার নেই, শিক্ষক সংকটে শিক্ষা কার্যক্রম

ল্যাব ও যন্ত্রপাতি নেই, চলছে শিক্ষা কার্যক্রম