শতবর্ষে সত্যজিৎ: সেটাই যে শেষ দেখা হবে ভাবিনি

অভিনেত্রী ববিতার বয়স তখন মাত্রই ১৬ বছর। সেসময়ই দুর্দান্ত এক প্রস্তাব আসে তার কাছে। ভারতের জাঁদরেল নির্মাতার ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ। এ সিনেমাই মোড় ঘুরিয়ে দেয় অভিনেত্রীর। ববিতার আজকের ববিতা হয়ে ওঠার পেছনে চরিত্র ‘অনঙ্গ বৌ’-এর ভূমিকা অনেক। আর সেই চরিত্রের কারিগর ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নির্মাতা-লেখক সত্যজিৎ রায়। সিনেমাটির নাম ‘অশনি সংকেত’। চলচ্চিত্রকারের জন্মশত বর্ষে সেই সময়ের স্মৃতি তুলে ধরেছেন ববিতা-

এখনও চোখে ভাসে ১৯৭২ সালের সেই দিনগুলোর কথা। ‘অশনি সংকেত’ নামের যুদ্ধবিরোধী ছবি তৈরি করতে চান মানিক দা (সত্যজিৎ রায়)। সেই সিনেমার জন্য নায়িকা খুঁজছিলেন তিনি। তার ক্যামেরাম্যান নিমাই ঘোষ ঢাকায় এসে আমার প্রায় ২শ ছবি তুলে নিয়ে গেলেন।

তখন আমার বয়স ১৬ বছর। এরপর অপেক্ষা। ডাক আর আসে না। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটে। প্রাথমিক মনোনয়নের খবর জানিয়ে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে চিঠি আসে আমার কাছে। বড়বোন সুচন্দাকে সঙ্গে করে গেলাম ভারতে। আমাকে ইন্দ্রপুরের স্টুডিওতে আসতে বললেন। স্টুডিওতে নানা প্রশ্ন করলেন তিনি।

এরপর তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমি অনঙ্গ বৌ পেয়ে গেছি!’ এক সময় পাণ্ডুলিপি হাতে পাই। তারপর ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া হয়। সাধারণ একটি শাড়ি দেওয়া হয় পরতে। সেটা পরেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই। মানিক দা যেন আবারও মুগ্ধ। বলে উঠলেন, ‘মেয়েটি তো দারুণ ফটোজেনিক’। এরপর বাকি ইতিহাস তো সবারই কমবেশি জানা। সিনেমা মুক্তি পেল। আমার পরিচিত হলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।

খুব মিস করি মানিক দাকে। তার পাঠানো চিঠিগুলো সযতনে রেখে দিয়েছি। চিঠিগুলো এখনও পড়ি। অবাক হই কত ভালোবাসা মাখানো সেসব চিঠি। বোম্বে থেকে প্রোডিউসাররা আমার খোঁজে মানিক দার কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে। তিনি সেগুলো পাঠিয়ে আমাকে লিখছেন, ‘তুই কাজ করবি কি না নিজে সিদ্ধান্ত নিবি। ভালো মন্দ যাচাই করে। আমি শুধু যোগাযোগ করিয়ে দিলাম।’ শর্মিলা ঠাকুর, জয়া ভাদুড়ি, অপর্ণা সেন তারা সবাই মানিক দার মাধ্যমে পর্দায় এসেছেন। পরে তারা সবাই তো বোম্বেতে (বলিউড) শাইন করলেন। আমিও হয়তো করতাম। কিন্তু যাইনি।

আমার বেডরুমের বড় অংশ জুড়ে মানিক দার বড় বড় ছবি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মানিক দার ছবি। এগুলো যতবার দেখি ততবার মনে হয়। তিনি আছেন।

মানিক দা খুব অসুস্থ। ৯২ সালই হবে। সেটাই যে শেষ দেখা হবে তা ভাবিনি। হাসপাতালে গেলাম, কথা বলতে পারতেন কম। বৌদি বললেন, ‘এসেছিস!’ কিন্তু কথা খুব একটা বলতে পারবে না। আমি চেয়েছিলাম ফ্যালফ্যাল করে আমার সেই মানিক দার দিকে। সেটাই পরে শেষ দেখা হলো।