দু’দিন ধরে সব দেখছি, এবার কিছু বলি: ইমন

ইমনের গাওয়া একটি গান এবারের অস্কার দৌড়ে সামিল হয়েছে। বলা যায় প্রথম কোনও বাঙালি গায়িকার গান অস্কার দৌড়ে যুক্ত হলো। খবরটি জানার পর থেকে ইমন খুব ফুরফুরে মেজাজে আছেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ঘটনা ঠিক তার উল্টো। ৫ ডিসেম্বরের একটি কনসার্টের সূত্র ধরে বেঁধে গেছে তুমুল গণ্ডগোল। যার ফলে যেমন বাহবা পাচ্ছেন গায়িকা, তেমনি সইতে হচ্ছে সমালোচনাও। 

রবিবার (৮ ডিসেম্বর) সেই ঘটনা বা অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বিস্তারিত মুখ খুললেন গায়িকা। সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘আমার মাকে যেমন খারাপ বলার অধিকার কেউ দেয়নি। ঠিক সেই ভাবে আমার ভাষাকে ছোট করার অধিকারও কেউ কাউকে দেয়নি।’

এদিন নিজের ফেসবুক পেজে ইমন আরও লিখেছেন, ‘‘আমি ফেসবুকে ছিলাম না বহুদিন। আমার টিম দেখভাল করতো। কিন্তু গতকাল ফেসবুক ডাউনলোড করে এসব দেখে অভিভূত যে, আমি হয়তো বহু মানুষেরই মনের কথা বলতে পেরেছি জোর গলায়। অনেকে বলছেন, আমি নাকি ভোটে দাঁড়ানোর জন্য বলেছি। আবার অনেকে বলছেন, ‘আপনি যখন হিন্দি গান করেন, তার বেলায়?’ অনেকে বলছেন, ‘হিন্দি গান করতে বলাটা দোষের কিছু নয়’। আমি শুধু দু’দিন ধরে সব দেখছি, এবার কিছু কথা বলি।’’ তার বিরুদ্ধে ওঠা তির্যক মন্তব্যের পাল্টা উত্তর দিয়েছেন ইমন। তার স্পষ্ট জবাব, ‘আমি মহান হওয়ার জন্য এই কথাটা বলিনি। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ, খেটে খাই। মঞ্চে উঠে পারফর্ম করি বা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গিয়েও গাই। সবটা ঘিরেই গান, ওটাই পারি আমি। তাই ওটাই করি। সংগীত আমার কাছে সব, মানে সব। সব ধরনের গান গাওয়ার ইচ্ছে আমার বহু দিনের। আমি কোথাও কখনও কাউকে বলিনি যে, আমি শুধু বাংলা ভাষায় গান গাইবো। কিন্তু আমাকে আমার এই জায়গা দিয়েছেন আপামর বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষ।’

নিজের সম্পর্কে ইমন আরও বলেন, ‘আমি বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা একটি মেয়ে। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারা একটি মেয়ে। এখানে আমার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন থাকেন। আমার গোটা পৃথিবী এখানে থাকেন। কোথাও কেউ কোনোভাবে আমার ভাষাকে ছোট করে কথা বললে, আমি আবার ওই একই কথাই বলবো। একই ভাবে প্রতিবাদ করবো। তাতে কেউ যদি ভাবেন যে, আমার স্বার্থ এতে চরিতার্থ হচ্ছে, তা হলে সেটা তাদের ভাবনা, আমার না। সব ভাষার সমান গুরুত্ব আছে অবশ্যই। আমার মাকে যেমন খারাপ বলার অধিকার কেউ দেয়নি। ঠিক সেভাবে আমার ভাষাকে ছোট করার অধিকারও কেউ কাউকে দেয়নি।’

ইমনের এমন পোস্টে ভক্তরা কুর্ণিশ জানিয়েছেন। একজন মন্তব্য করেছেন, ‘ইমন তোমার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা নিয়ো। এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র। তুমিই পথ দেখালে তোমার প্ল্যাটফর্ম থেকে।’ 

আরেকজন লিখেছেন, ‘আমরা সবাই আছি পাশে। এটা আমাদের সবার মনের কথা, অস্তিত্বের কথা, আত্মসম্মান-এর কথা। সব ভাষা, সব জাতির শিল্প সংস্কৃতি, সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা রয়েছে আমাদের। কিন্তু মাতৃভাষাকে আমরা কখনোই অপমানিত হতে দিতে পারি না।’

এবার একটু পেছনে যাওয়া যাক। ঠিক কী ঘটেছিল ৫ নভেম্বরের কনসার্টে। 

বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) এক বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন ইমন। গানের মধ্যেই চিৎকার করে এক যুবক বলে ওঠেন, ‘হিন্দি গানা গাইয়ে না নাচেঙ্গে (হিন্দি গান গাইতে হবে, নাচবো)। কথাটি ইমনের ভালো লাগেনি। মঞ্চেই প্রতিবাদ করেন তিনি। চিৎকার করে বলেন, ‘জোরের সঙ্গে বলো যে, আমি বাংলা গান শুনব না। এটা অন্য কোনও জায়গা হলে চুলের মুঠি ধরে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিতো। বাংলায় থাকছো, বাংলায় রোজগার করছো, বাংলা গান শুনবে না বলছো?’  ইমন চক্রবর্তীবাংলা গান, বাংলা ভাষার প্রতি ইমনের এমন ভালোবাসা দেখে অনেকেই তাকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন। অভিনেতা টোটা রায় চৌধুরী প্রশংসা করেছেন ইমনের সাহসের। কুর্নিশ জানিয়েছেন গায়িকার প্রতিবাদকে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘অনুষ্ঠানে শিল্পীর কাছে পছন্দের গানের অনুরোধ রাখতেই পারি। কিন্তু হুকুম করতে পারি কি? বা বাংলায় দাঁড়িয়ে বলতে পারি কি, বাংলা গান শুনব না? মঞ্চে যিনি গাইছেন তিনি যে মূলত বাংলা গান গেয়েই জাতীয় স্তরে সম্মানিত, সেটা না জেনেই তার প্রোগ্রাম দেখতে চলে এসেছি?’

কণ্ঠশিল্পী সোমলতা আচার্য জানান, অনুষ্ঠানের অনুরোধ এলে তার দল আগে দেখে, কোথায় অনুষ্ঠান হচ্ছে। শ্রোতারা বাংলা গান শুনবেন কি না। কলকাতার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তার কড়া নির্দেশ, বাংলা গান শুনতে না চাইলে তিনি সেই অনুষ্ঠান করবেন না। নিজের শহরের মাতৃভাষার অপমান সহ্য করবেন না।ইমন চক্রবর্তী

এমন ইতিবাচকতার বিপরীতে আছে নেতিবাচকতাও। অনেকেই আবার ইমনকে খোঁচা দিতে ছাড়ছেন না। অনেকে বলছেন, ইমন বেশি বেশি ভাব দেখিয়েছেন, যেন তিনিই বাংলায় থাকেন, বাংলা ভাষা ভালোবাসেন। অনেকে তো বলেই ফেলেছেন, নিশ্চয়ই ভোটে দাঁড়ানোর ফন্দি।

উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের অস্কারের মনোনয়নে জায়গা করে নিয়েছে ইমনের গাওয়া একটি বাংলা গান। ইন্দিরা ধর মুখার্জির পরিচালনায় ‘পুতুল’ ছবির জন্য ‘ইতি মা’ নামে একটি গান গেয়েছিলেন ইমন। আর সেই গানই এবার অস্কারের দৌড়ে।