নাসরাল্লাহকে হত্যা করেও হিজবুল্লাহকে দমাতে পারেনি ইসরায়েল

লেবাননের ইরানপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহসহ দলটির প্রায় পুরো নেতৃত্ব মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। বৈরুতে গোষ্ঠীটির প্রধান কার্যালয়ে দুই হাজার পাউন্ডের কয়েক ডজন বোমা বর্ষণের ফলে মৃত্যু হয় হিজবুল্লাহকে দীর্ঘদিন পরিচালনা করা এই নেতার। ফলে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব পুনর্গঠনে দলটি যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

এখন যদিও ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেকে তাদের এই আপাত সাফল্যে খুবই উচ্ছ্বসিত, বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক কয়েক দফা সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া হিজবুল্লাহ নিজেদের সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠনে সক্ষম। ইরানের তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষের’ রাজমুকুট এই দলটি। হিজবুল্লাহর টিকে থাকা নিশ্চিত করতে ২০০৬ সালে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর ৩৪ দিনের যুদ্ধের পর যেমনটা করেছিল, তেমনই আবারও পর্যাপ্ত সহায়তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডস।

নাসরাল্লাহর সম্ভাব্য উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন হিজবুল্লাহর নির্বাহী পরিষদের প্রধান ও জিহাদ পরিষদের সদস্য হাশেম সাফেইদ্দিন। দলটির সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রেও একজন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তদাতা তিনি। এছাড়া ইরানের কুদস ফোর্সের প্রয়াত কমান্ডার কাশেম সোলায়মানির মেয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ সাফেইদ্দিনের ছেলে। আবার হিজবুল্লাহর উপপ্রধান নাইম কাশেমের গভীর আনুগত্য রয়েছে ইরানের প্রতি। অর্থাৎ তেহরানের সঙ্গে দলটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

প্রায় চার দশকেরও বেশি আগে, ১৯৮২ সালে দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় আবির্ভাব হয় হিজবুল্লাহর পূর্বসূরি ইসলামিক জিহাদের। তারা প্রায় ১৮ বছর সক্রিয় ছিল।

একসময় ‘র‍্যাগট্যাগ মিলিশিয়া’ বলে অবহেলিত হিজবুল্লাহ এখন দেশের মধ্যে আরেকটি দেশের মতো পরিচালিত হয়। তাদের দাবি অনুযায়ী, দলটিতে প্রায় ৩০ হাজার অস্ত্রধারী প্রশিক্ষিত সদস্য রয়েছে। আর তাদের ভাণ্ডারে রকেট, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্রসহ প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার অস্ত্র রয়েছে। লেবাননের পার্লামেন্টে কয়েক ডজন হিজবুল্লাহর সদস্য রয়েছেন।

লেবাননজুড়ে এক বিস্তৃত সামাজিক পরিষেবা পরিচালনা করে হিজবুল্লাহ। জিহাদ আল বিনা নামে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান দেশে অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ও শরণার্থীদের জন্য কাজ করে থাকে। ইসরায়েলের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত লেবানিজদের ঘরবাড়ি মেরামত করে থাকে তারা। এভাবে লেবাননের মানুষের কাছে তাদের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে।

স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে হিজবুল্লাহর দীর্ঘায়ুতে অবদান রাখবে এমন আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। অবিলম্বে, হিজবুল্লাহ তার অত্যাধুনিক প্রচার যন্ত্র ব্যবহার করতে চাইবে, যার মধ্যে রয়েছে তার নিজস্ব টেলিভিশন স্টেশন, আল-মানার, সমগ্র আরব ও ইসলামিক বিশ্বের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকে পুঁজি করে।

হিজবুল্লাহর টিকে যাবার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আরও কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যায়। তারা আপাতত ইসরায়েলি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে উসকে দিতে চাইবে। এ উদ্দেশ্যে তাদের প্রচারণা চালাতে নিজস্ব টিভি স্টেশন আল-মানার ব্যবহার করবে তার। পেজার ও ওয়াকি টকি বিস্ফোরণ এবং শেষ কিছুদিন ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার লেবাননে এই কাজ করতে তাদের বেশি বেগ পেতে হবে না।

আর দেশের ভেতর থেকে সূক্ষ্মভাবে দেশ পরিচালনা করার কারণে হিজবুল্লাহর ঘুরে দাঁড়ানোর দীর্ঘমেয়াদি নকশাও করা আছে। তথাকথিত দাঁড়িপাল্লায়, লেবানন ব্যর্থ একটি দেশ, দেশের সরকার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জনগণের দেখভালে ব্যর্থ, সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষায় অসমর্থ। সরকারের ঘাটতি পূরণে এগিয়ে আসে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের যোদ্ধা তৈরি করার জন্য শিশুদের নিয়ে গ্রীষ্মকালীন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও ভিডিও গেম বাজারে ছাড়ার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে তারা।

পরবর্তী কয়েকমাস সশস্ত্র গোষ্ঠীটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। ইসরায়েল কীভাবে তাদের সংগঠনের ভেতরের তথ্য পাচ্ছে তা হিজবুল্লাহকে খুঁজে বের করতে হবে। তেল আবিবকে তথ্য সরবরাহ করা ‘বিশ্বাসঘাতকের’ সন্ধানে তাদের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা দল ইতোমধ্যে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে।

অবশ্য তথ্য সংগ্রহে মোসাদ হয়ত কেবল ‘হিউম্যান ইন্টেলিজেন্সের’ ওপর নির্ভরশীল নয়। স্পাই স্যাটেলাইট, ড্রোন ও হ্যাকিং এর মাধ্যমেও তারা যথেষ্ট গোপন খবর জানার সক্ষমতা রাখে।

তবে, হিজবুল্লাহর টিকে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ বলে গণ্য হতে পারে ইসরায়েলের সঙ্গে শত্রুতা। হামাসের মতো দলগুলোর যেখানে কেবল নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে (স্বাধীনতা), সেখানে হিজবুল্লাহ ইহুদি রাষ্ট্রটিরই বিরোধী। ফলে, তাদের ভবিষ্যৎ সংঘর্ষ অনিবার্য। আর নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইলে যেকোনও মূল্যে গোষ্ঠীটিকে টিকে থাকতেই হবে।

ইসরায়েলের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে হিজবুল্লাহর ভবিষ্যৎ। বছরের অবশিষ্ট সময়ে যা ঘটে, তার ওপর নির্ভর করবে লেবানিজ সংগঠনটির পুনরুত্থান। হামাসের সঙ্গে নিয়মিত সংঘর্ষকে ‘আগাছা ছাঁটা’ বলে উপহাস করে থাকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। অর্থাৎ বাগানের ঘাসের মতোই তাদের নিয়মিত ‘ছেঁটে’ রাখতে হয়। হিজবুল্লাহর জন্যও এ মন্তব্য সঠিক। ইসরায়েলের চলমান ‘পোড়ামাটি সামরিক অভিযান’ সত্ত্বেও, হয়ত আগের চেয়ে শক্তিশালী ফেরত আসতে পারে হিজবুল্লাহ।

তথ্যসূত্র: আল মনিটর