দেশ পরিচিতি: চাদ

মধ্য আফ্রিকার ভূমিবেষ্টিত অর্ধ মরুর দেশ চাদ। চাদ অথবা শাদ, দুটি নামেই পরিচিত দেশটি স্বর্ণ ও ইউরেনিয়ামে সমৃদ্ধ। সম্প্রতি তেল রফতানিকারক দেশ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে চাদ।

আয়তনের দিক থেকে আফ্রিকার পঞ্চম বৃহত্তম দেশ চাদ। ভূমিবৈচিত্রময় দেশটির উত্তরে বিশাল মরুভূমি, মধ্যাঞ্চল অনুর্বর এবং দক্ষিণাঞ্চল বেশ উর্বর। চাদ হ্রদের নামানুসারেই নামকরণ করা হয়েছে দেশটির।

স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশটিতে সহিংস ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। দেশটির উত্তর অংশে বসবাসকারী আরব মুসলিম ও দক্ষিণ অংশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের কারণে এই সংকট দেখা দেয়। এছাড়া উত্তরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং সাহেল অঞ্চল ও চাদ অববাহিকাজুড়ে জিহাদি অভ্যুত্থান গড়ে উঠেছে। 

এসব কারণে অবকাঠামোগত দূর্বলতার পাশাপাশি দারিদ্রে জর্জরিত অবস্থা দেশটির। দেশটির সামাজিক সংকট ও স্বাস্থ্য খাতের অবস্থাও করুণ।  

২০০৩ সাল থেকে তেল উৎপাদন শুরু করে চাদ। তেলক্ষেত্রগুলোকে আটলান্টিক উপকূলে টার্মিনালের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ৪ বিলিয়ন ডলারের পাইপলাইন তৈরি করেছিল দেশটি।

চাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য

  • রাষ্ট্রীয় নাম: রিপাবলিক অব চাদ
  • রাজধানী: এনজামেনা
  • আয়তন: ১২ লাখ ৮৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার
  • জনসংখ্যা: ১ কোটি ৭৯ লাখ
  • প্রধান ভাষা: ফরাসি, আরবি
  • গড় আয়ু: পুরুষ ৫১, নারী ৫৪ বছর

নেতৃত্ব

অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল মহামত ইদ্রিস দেবি ইতনো

অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল মহামত ইদ্রিস দেবি ইতনো

২০২১ সালের এপ্রিলে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে সাবেক প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস দেবি মারা যাওয়ার পর তার ছেলে জেনারেল মহামত ইদ্রিস অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন।

স্বৈরশাসক হিসেন হাব্রে’র পতনের পর ১৯৯০ সালে নিজেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ইদ্রিস দেবি। পরবর্তীতে দেশটিতে বহু-দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করে নির্বাচনের আয়োজন করেন। এরপর নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় থাকেন তিনি।

২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তা স্থগিত থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

চাদ লেক

সংবাদমাধ্যম

দেশটির কাগজে কলমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সরকারের সমালোচনার অনুমতি থাকলেও সেলফ-সেন্সরশিপের কারণে সাংবাদিকরা তা এড়িয়ে চলে।

সংবাদপত্র নিজেদের সম্পাদকীয় প্রকাশ করতে পারে। তবে উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের ঘনিষ্ঠ কারো বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিপুণভাবে দমন করা হয় দেশটিতে।

চাদের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা

১৮৮৩-৯৩: ওউদাই, বাগুইরমি এবং কানেম-বোর্নু অঞ্চল জয় করে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সুদানি আভিযাত্রিক রাবিহ আল-জুবায়ের। রাজ্যটির ভূখণ্ড বর্তমানে চাদ নামে পরিচিত।

১৯০০: ফরাসিদের কাছে পরাজিত হয় রাবিহ আল-জুবায়েরের সেনারা। ১৯১৩ সালে ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিণত হয় দেশটি।

১৯৪৬: নিজস্ব আঞ্চলিক সংসদ এবং ফরাসি জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্ব অর্জন করে চাদ।

১৯৬০: স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে চাদ।

১৯৬৩: রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞার তীব্র বিরোধিতা করে দেশটির উত্তরাঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠী।

১৯৬৬: গেরিলা যুদ্ধে রূপ নেয় দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় বিদ্রোহ।

সাহারায় এনেদি পাহাড়

১৯৭৩: বিদ্রোহ দমাতে চাদ সরকারকে সাহায্য করে ফ্রান্স। তবে লিবিয়ার সহায়তায় ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকজুড়ে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায় বিদ্রোহীরা।

১৯৭৭: চাদের অংশ থাকা আউজৌ উপত্যকা দখল করে নেয় লিবিয়া। এরপর ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট গৌকুনি ওয়েইদেইকে সমর্থন করে উত্তরাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের জন্য সেনা সহায়তা পাঠান। দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হিসেন হাব্রে।

১৯৮১: ওয়েদেই’র অনুরোধে চাদ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে লিবিয়া।

১৯৮২: চাদের ক্ষমতা দখল করেন হিসেন হাব্রে। পরবর্তীতে স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। তার শাসনামলে রাজনৈতিক গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে।

১৯৮৩: হাব্রে সরকারকে স্বীকৃতি দেয় অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিটি। কিন্তু ওয়েদেইয়ের বাহিনী লিবিয়ার সাহায্যে উত্তরে বিদ্রোহ চালিয়ে যায়।

১৯৮৭: ফরাসি ও মার্কিন সহায়তায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও চাদ সরকারের সম্মিলিত সেনারা আউজৌ উপত্যকা ও তিবেস্তির কিছু অংশ পুনর্দখল করে এবং দেশটি থেকে লিবিয়ার সেনা বিতাড়িত করে।

১৯৯০: হিসেন হাব্রের পতন ঘটান ইদ্রিস দেবি।

১৯৯৪: আউজৌ এর ওপর লিবিয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত। উপত্যকাটির ওপর চাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৯৬: চাদের প্রথম বহু-দলীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন ইদ্রিস দেবি।

১৯৯৮: দেবির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউসুফ তোগোইমির নেতৃত্বে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়।

২০০৬: প্রেসিডেন্ট দেবিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দেশটির রাজধানীর বাইরে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগে সুদানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে চাদ সরকার। জাতিগত সহিংসতার পর সুদানের দারফুর অঞ্চলের সীমান্তবর্তী পূর্বাঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

২০০৭: প্রতিবেশী দেশ সুদানের দারফুরের সহিংসতা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করতে জাতিসংঘ-ইইউ শান্তিরক্ষা বাহিনীকে মোতায়েন করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ।

কুখ্যাত হিসেন হিব্রে

২০০৯: ইউনিয়ন অব রেজিস্ট্যান্স ফোর্সেস (ইউএফআর) নামে আটটি বিদ্রোহী দল একত্রিত হয়ে নতুন বিদ্রোহী জোট গঠন করে। মিনারক্যাট নামে পরিচিত একটি নতুন ও বৃহত্তর জাতিসংঘ বাহিনীর হাতে পূর্ব চাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

২০১০: সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সঙ্গে খার্তুমে সাক্ষাৎ করেন ইদ্রিস দেবি। ছয় বছরের মধ্যে তাদের প্রথম বৈঠক এটি।  সীমান্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য যৌথ বাহিনী মোতায়েন করতে সম্মত হয় চাদ ও সুদান। দারফুর সংঘাত জোর করে বন্ধ করার সাত বছর পর চাদ-সুদান সীমান্ত আবার চালু হয়।

২০১২: উত্তর নাইজেরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে বোকো হারাম জঙ্গিদের মোকাবিলা করার জন্য একটি যৌথ সামরিক বাহিনী গঠনের আহ্বান জানায় চাদ। সাবেক নেতা হিসেন হাব্রের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সেনেগাল ও আফ্রিকান ইউনিয়ন।

২০১৬: মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন হিসেন হাব্রে। সেনেগালের আফ্রিকান ইউনিয়ন-সমর্থিত আদালতে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

২০২১: বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে মারা যান প্রেসিডেন্ট দেবি।