তালেবানের উত্থানে সন্ত্রাসবাদের ভয় ছড়াচ্ছে মস্কো থেকে বেইজিংয়ে

তালেবানের বিদ্যুৎগতির অগ্রগতি থেকে আফগানিস্তানের বেশিরভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ফলে রাশিয়া থেকে চীনে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সতর্কতা বাড়াচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহারের ফলে দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে ক্ষমতার ভারসাম্য সংকটে পড়েছে। গত দুই দশকে এই ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিল মার্কিন, ন্যাটো ও বিদেশি সেনারা।

গত সপ্তাহে অন্তত ১ হাজার আফগান সেনা তাজিকিস্তানে পালিয়েছে। এতে করে সীমান্ত সুরক্ষায় আরও ২০ হাজার সেনাকে পাঠিয়েছেন তাজিক প্রেসিডেন্ট। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তালেবানের কাছ থেকে নিশ্চয়তা চেয়েছেন তারা ক্ষমতায় গেলে তাজিক সীমান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে বলে। প্রতিবেশী পাকিস্তান জানিয়েছে, শরণার্থীদের জন্য নিজেদের সীমান্ত উন্মুক্ত করবে না তারা।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ি গত সপ্তাহে সতর্ক করে বলেছেন, আফগানিস্তানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা এড়ানো। তিনি আগামী সপ্তাহে মধ্য এশিয়া সফর করবেন আফগান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারকে ‘হঠকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটনের অবশ্যই উচিত আফগানিস্তান যেনও ফের সন্ত্রাসবাদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত না হয় সেই প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।

ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাড়াহুড়ো করে আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সেনাদের প্রত্যাহার করেছে এবং আফগান জনগণকে চরম বিশৃঙ্খলায় রেখে গেছে। অথচ তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় উদ্বেগ জানানোর মতো ভণ্ডামি করে।

শুক্রবার তালেবানের দোহায় অবস্থিত রাজনৈতিক কার্যালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা মোহাম্মদ সুহেল শাহীন বলেন, তালেবান কাউকে বা কোনও গোষ্ঠী চীন বা অন্য দেশের বিরুদ্ধে আফগান ভূমি ব্যবহার করতে দেবে না। এটা আমাদের অঙ্গীকার।

বৃহস্পতিবার বাইডেন জোর দিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তানে নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করেছে মার্কিন সেনাবাহিনী এবং ৩১ আগস্টের মধ্যে দেশটি ছাড়বে। টুইন টাওয়ার হামলার ২০তম বার্ষিকী আগে ২ হাজার ৪৪৮জন মার্কিন সেনার জীবন ও প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পর কাবুল ছাড়ছে তারা। তবু আফগানিস্তানের জনগণের লড়াই চলবে এবং প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে ৬০ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর হুমকিতে পড়তে পারে।

আফগানিস্তান ছাড়ছে বিদেশি সেনারা

সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ইউনিভার্সিটির মিডল ইস্ট স্টাডিজ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ফ্যান হংডা বলেন, আফগানিস্তানের বিশৃঙ্খলা অন্যান্য দেশে ছড়াতে পারে এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা তৈরির দিকে আগাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিতে চায় না চীন কিন্তু আশা করে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা সহজ করতে। কারণ অঞ্চলটিতে তাদের স্বার্থ রয়েছে।

সম্প্রতি নাটকীয় মাত্রায় আফগান ভূখণ্ডে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে তালেবান। লং ওয়ার জার্নালের সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে মাত্র ২০ শতাংশ ভূখণ্ড রয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি এখন ৪০৭টির মধ্যে ২০৪টি নিয়ন্ত্রণ করছে। মে মাসের শুরুর তুলনায় ৭৩টি বেশি। আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাত্র ৭৪ জেলা। বাকিগুলোতে সুনির্দিষ্ট কারও নিয়ন্ত্রণ নেই।

শুক্রবার সিনিয়র তালেবান কর্মকর্তা শাহাবুদ্দিন দেলাওয়ার বলেছেন, আফগানিস্তানের সীমান্ত এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। এগুলো উন্মুক্ত ও সক্রিয় থাকবে। তিনি বলেন, আমরা সবাইকে নিশ্চয়তা দিতে চাই যে, আমরা কূটনীতিক, দূতাবাস, কনস্যুলেট, এনজিও এবং তাদের কর্মীদের টার্গেট করব না।

সীমান্তের কিছু এলাকা তালেবানরা নিয়ন্ত্রণে নিলেও তা বেশিদিন টিকবে না বলে জানিয়েছেন আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক উপ-মুখপাত্র ফাওয়াদ আমান। শনিবার তিনি বলেন, আমরা আক্রমণের হামলা বাড়িয়েছি এবং শিগগিরই ওই এলাকাগুলো মুক্ত ও পুনরুদ্ধার করা হবে।

এই মুহূর্তে কাবুলে অবস্থিত সরকার ৩৪টি প্রাদেশিক রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও প্রতিবেশী পাকিস্তান,চীন, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে অবস্থিত দুটি রাজধানী দখলে লড়াই শুরু করেছে তালেবান। সম্প্রতি তালেবান যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা জোরদার করেছে আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

২০ বছরের মার্কিন যুদ্ধের পরও তালেবানের উত্থানে ভেঙে পড়ছে আফগান সরকার ও সেনাবাহিনী

যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের যুদ্ধের পরও তালেবানের মসৃণ উত্থান আফগান সরকার ও সেনাবাহিনীকে ভেঙে পড়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেমনটি ঘটেছিল ১৯৯০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে যাওয়ার পর। ওয়াশিংটন আফগানিস্তানে আল-কায়েদার শক্তিশালী হওয়া ঠেকাতে চায়। কিন্তু প্রতিবেশী ছয়টি দেশের জন্য এর প্রভাব ভয়ানক হতে পারে। বিশেষ করে ভারতের কাছাকাছি থাকা দেশগুলো প্রায়ই জিহাদি হামলার শিকার হয়।

এপ্রিলে পাকিস্তানের কোয়েটা শহরে চীনা দূতাবাস অবস্থান করা বিলাসবহুল হোটেলে গাড়িবোমা বিস্ফোরণের পর আঞ্চলিক ঝুঁকি স্পষ্ট হয়ে গেছে। দক্ষিণ আফগানিস্তানে তালেবানের শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে কোয়েটা শহরটি খুব বেশি দূরে নয়। এই হামলাটির দায় স্বীকার করেছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। এতে প্রতীয়মান হয়েছে এতদ অঞ্চলের সরকারগুলোকে হাই-প্রোফাইল কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীদের নিশ্চিত করতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে।

‘গুরুতর হুমকি’

ভারতে নিযুক্ত আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত ফরিদ মামুনডিজায় বলেন, রাশিয়া থেকে ভারতে ছড়িয়ে থাকা বিস্তৃত অঞ্চলে তালেবানের সঙ্গে প্রায় ২০টির মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। সরেজমিনের এরই মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং অঞ্চলটির জন্য গুরুতর হুমকি।

১৯৯০ দশকে তালেবানের উত্থানে সহযোগিতা করা পাকিস্তান টিটিপি’র পুনরুত্থান নিয়ে শঙ্কিত। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন দখল অভিযানের পর দেশটিতে ৭০ হাজার বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর জন্য এই গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়। অল্প কয়েক মাস আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় টিটিপি কোনঠাসা হয়েছিল। এখন আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান এবং দেশটি থেকে মার্কিন ও বিদেশি সেনা প্রত্যাহারে পর জঙ্গি গোষ্ঠীটি চীনা প্রকল্পে হামলা চালিয়ে ইসলামাবাদকে চাপে ফেলার সুযোগ পাবে।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্প কোঅপারেশনের ফেলো আফসানদিয়ার মির বলেন, এই গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানকে আঘাত করতে চায় এবং এসব হামলায় সবচেয়ে বেশি জর্জরিত হবে। চীন-পাকিস্তান করিডোরের নিরাপত্তার জন্য আফগানিস্তানের পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

মস্কোয় রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় তালেবান প্রতিনিধি দল

চীনা টার্গেটগুলো

আফগানিস্তানে মার্কিন দখল অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে চীনের অর্থনীতি পাঁচগুণ বেড়েছে। এতে করে চীন একটি সুনির্দিষ্ট টার্গেটে পরিণত হয়েছে। বেইজিং ও ইসলামাবাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশজুড়ে সিপিইসি প্রকল্পের সুরক্ষার জন্যই একটি বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে।

আফগানিস্তানে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায়ের মতে, তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তান একপক্ষে চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক দৃঢ় করবে, অপরপক্ষে শক্তিশালী হবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক। মাঝখোনে থাকা রাশিয়া ও ইরান হুমকির ভিত্তিতে নিজেদের নীতি সমন্বয় করবে।

নয়া দিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চে সিনিয়র ফেলো হিসেবে কর্মরত মুখোপাধ্যায় বলেন, এই অঞ্চল গুরুতর প্রভাবিত হবে। কিন্তু বাকি বিশ্বও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন, চরমপন্থা ও সহিংসতা থেকে রক্ষা পাবে না।

শরণার্থীদের পলায়ন

তালেবানরা আবার যখন বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে বিভিন্ন আফগান গ্রামের লোকজন কিছুটা নিরাপদ বড় শহরের দিকে ছুটছে। পাকিস্তান ধারণা করছে ৫ লাখ শরণার্থীর এবং কর্তৃপক্ষ বলছে তাদের সীমান্ত শিবিরে রাখা হবে। এরই মধ্যে পাকিস্তানে ১৪ লাখ নিবন্ধিত আফগান শরণার্থী অবস্থান করছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের একজন ডেভিড এম. রুবেনস্টেইন ফেলো মাদিহা আফজাল মনে করেন, তালেবানের জয়ের ফলে পুরো অঞ্চলজুড়ে তাদের শুভাকাঙক্ষীদের উৎসাহিত করবে। তিনি বলেন, এসব গোষ্ঠীর মাঠের যোদ্ধারা দল পরিবর্তন করে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাওয়া এবং তালেবানের অবস্থানকে তারা জিহাদিদের জয় হিসেবে দেখবে। সূত্র: ব্লুমবার্গ