তালেবান ইস্যুতে ডুবন্ত ভারত, ‘খড়কুটো’ রাশিয়া

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। মোদির মুখে টেনশন। ওদিকে গোয়েন্দা অফিসে থুতনিতে হাত রেখে ডিজিটাল পর্দায় তাকিয়ে কী যেন দেখছেন গোয়েন্দা-প্রধান। হাতে কাগজপত্র নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে একদল এজেন্ট। আইটি কর্মীরা নির্ঘুম চোখ রাখছে সদ্য গজিয়ে ওঠা জঙ্গি গ্রুপগুলোতে। মিটিং ডেকে তড়িঘড়ি একটি হাই-লেভেল মনিটরিং গ্রুপ গঠনের নির্দেশ দিলেন মোদি। আফগানিস্তানে কী হয় না হয়, বড় ধরনের হামলার ছক কষছে কিনা, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেউ ভারতে সিঁধেল চোরের মতো ঢুকে পড়ছে কিনা; কত কী দেখবে একসঙ্গে! খানিক পর ক্রেমলিনে ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলো ফোন। রিসিভার তুললেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এক ঢোক পানি গিলে, ঘামটা মুছে মুখে কাষ্ঠ হাসি এনে নরেন্দ্র মোদি বললেন, ‘হ্যালো মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’

কূটনৈতিকপাড়া যতই টেনশনে ঘাম ঝরাক না কেন, ভারতীয় ওয়েব সিরিজ নির্মাতাদের জন্য এখন চিত্রনাট্য লেখার উৎকৃষ্ট মৌসুম চলছে। নরেন্দ্র মোদি যেখানে পুরোদস্তুর ‘ফ্যামিলি ম্যান’। ‘পরিবারের’ সুরক্ষায় যাকে পাবেন তার হাতে-পায়ে ধরতে প্রস্তুত তিনি।

আমার বন্ধুর শত্রু মানে আমারও শত্রু; কিংবা শত্রুর শত্রু মানে আমার বন্ধু, কূটনীতির বেলায় প্রচলিত বন্ধুত্বের এ ফর্মুলা খাটে না। এখানে চলে স্বার্থের খেলা। বন্ধুর শত্রু যদি বড় কোনও ব্যবসায়িক চুক্তি নিয়ে হাজির হয়, তবে তার সঙ্গে আধাআধি বন্ধুত্বে জড়াতে সমস্যা কোথায়? কিন্তু শত্রুর বন্ধু যখন বেড়ে যায়, কিংবা বন্ধুর শত্রুর সঙ্গে বন্ধুতা গড়তে গিয়ে যখন বন্ধুর চক্ষুশূল হতে হয়, তখন ধীরে ধীরে একঘরে হয়ে পড়তে হয় একজনকে। সেই একজনই হলো ভারত। কেউ আছে টেনশন-ফ্রি। কারও ভেতর সাজ সাজ রব। আর ভারতের কাছে মনে হচ্ছে, পলিটিক্যাল-থ্রিলার সিরিজটার প্রথম সিজন শুরু হলো মাত্র।

সেটা কী রকম? আফগানিস্তান নিয়ে ভারত ওপরে ওপরে বলছে, ওদের সঙ্গে বন্ধুত্বই আপাতত তাদের লক্ষ্য। আর নিরাপদে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে পারলেই ভারত আপাতত খুশি। ভেতরে কিন্তু রক্তচাপ বেড়েই যাচ্ছে। এরমধ্যে আবার আইএস-কে নামের আরেক বিষফোঁড়া জানান দিলো, দাদা, আমরা কিন্তু আছি!

২৪ আগস্ট মোদি ফোন করেছিলেন পুতিনকে। বলেছিলেন, আফগান ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে একটি টু-ওয়ে চ্যানেল মানে দু-তরফা তথ্যবিনিময় ব্যবস্থা চায় ভারত। রাশিয়ার এতে কখনোই আপত্তি ছিল না, থাকার কথাও নয়। কিন্তু কদিন আগেও ভারত যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের দহরম-মহরম প্রচার করে বেড়ালো, তাতে এমন প্রস্তাবে রাশিয়া আদৌ বিশেষ পাত্তা দেবে কিনা...।

কোয়াড নিয়ে আলোচনার সময় পুতিনের চোখে চোখও রাখেননি মোদিএদিকে ভারতের কিছু গণমাধ্যম আবার আগ বাড়িয়ে বলে ফেললো, ভারতের সঙ্গে কোনও ধরনের আলোচনা না করে ক্রেমলিন সহসা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। কারণ, মোদির সঙ্গে ওরা এ ব্যাপারে একমত যে—কাবুলে তালেবানের উত্থানকে কাজে লাগিয়ে এ অঞ্চলে জঙ্গিবাদে ইন্ধন জোগাবে পাকিস্তান। এটা যে জোর করে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া, সেটা বুঝতে বাকি থাকে না কারও।

মস্কোর কী আদৌ এ অঞ্চলের চড়াই-উৎরাই নিয়ে মাথাব্যথা আছে? তারা তো ভারত-পাকিস্তানকে একটি ‘হাইফেন’ দিয়ে বিচার করে না। মানে, দুটো দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা সম্পূর্ণ আলাদা ও দৃষ্টিভঙ্গিও দুই ধরনের। তাদের গাণিতিক সমীকরণে পাকিস্তানের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো। তাদের ধারণা, ইউরেশিয়ান অঞ্চলে রাশিয়ার কিছু স্বার্থে পাকিস্তানই তাদের পক্ষে আছে, ভারত কখনোই ছিল না।

এদিকে কোয়াড নিয়ে মাসখানেক আগে যে হইচই হয়েছিল তাতে ভারত একতরফা যুক্তরাষ্ট্রকেই ‘বড় ভাই’ মেনে নিয়েছিল। চীন ও রাশিয়ার ডানায় ফিতা বেঁধে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক ব্লক তৈরির চেষ্টায় রীতিমতো সাধুবাদ জানিয়েছিল ভারত। জো বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত তালেবানের হেসেখেলে ক্ষমতা দখলের পর সেই কোয়াড-প্রস্তাবও এখন গিলতে কষ্ট হচ্ছে ভারতের। রাশিয়া তখন বারবার দিল্লিকে বলেছিল, কোয়াড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ তারা মোটেও ভালো চোখে দেখছে না। ওই সময় রাশিয়ার কথা কানেই তোলেননি মোদি।

এখন ঘোলা পানিতে মাছ ধরতে কাছা বেঁধেছে পাকিস্তান। সরকারি প্রেসনোটে ওরা যাই বলুক, মস্কোর সঙ্গে হাত মেলাতে ইসলামাবাদ ধরে নিয়েছে এর চেয়ে ভালো সময় আর হয় না। আফগানিস্তান ইস্যুতে রাশিয়া ও তালেবান কর্মকর্তাদের মাঝে মধ্যস্থতা করিয়ে দিতে পাকিস্তান রীতিমতো ফ্রি কনসালট্যান্সি দিতে মুখিয়ে আছে। সুযোগটা তো মস্কো নেবেই।

তাই ভারত যতই চেঁচাক ‘তালেবানরা পাকিস্তানের প্রক্সি ছাড়া আর কিছুই নয়’ মস্কো এটা দৃঢ় বিশ্বাস করে যে তালেবানরাই আফগানিস্তানের রাজদণ্ড হাতে নিতে চলেছে। আর রাশিয়ার অতি প্রাচীন আফগান-পলিসিতে এখন তারাও গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি। এ কারণে মোদি ফোন করার পরদিনই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ফোন করেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। তারা স্রেফ ‘কথার কথায়’ যে বিশ্বাসী নন, সেটা তাদের আলোচনার ব্রিফিংয়েই পরিষ্কার।

চীন সরকারও সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে (সূত্র: গ্লোবালটাইমস) বলেছে, রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সমন্বয় ও স্বার্থের মিল আছে, যা আফগানিস্তানের সম্ভাব্য পুনর্গঠনে সহায়ক হবে। তালেবানরাও কদিন আগে এক ভিডিও পোস্টে দেখিয়েছে, তাদের কর্মীরা দেশের অবকাঠামো গঠনে কোমর বেঁধে নেমেছে। এমন অবস্থায় চীন ও রাশিয়ার মতো দুটো শক্তিশালী বন্ধু পেলে তো আর কথাই নেই। যুক্তরাষ্ট্রের আটকে রাখা ডলারের অর্থনীতি থেকেই প্রয়োজনে বেরিয়ে আসবে তারা।

এখন ভারতের কী হবে?

২৬ আগস্ট পার্লামেন্টে ৩১টি দলের সামনে আফগান ইস্যুতে ভারতের অবস্থান কিছুটা ব্যাখ্যা করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রী জয়শংকর। তিনি তাতে পরিষ্কার বলেছেন, আপাতত মাথাব্যথা একটাই- কী করে আটকে পড়া প্রায় ৬০০ ভারতীয়কে দেশে ফেরানো যায়।

আইস-কে প্রসঙ্গে বাদ রাখলে বলা যায়, এক ধরনের নীরব যুদ্ধবিরতি চলছে এখন। তালেবানরাও চুপচাপ (যদিও তাদের এখনি ‘বদলে যাওয়া’ বা ‘নতুন প্রজন্মের’ ভাবার মতো কারণ ঘটেনি)। ওরা একফাঁকে অবশ্য বলেছে, আফগানিস্তানে ভারতের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তাদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী নিয়ে তারা বেশ নাখোশ। এসব জানতো বলেই হয়তো ভারত সামান্যতম দেরি না করে কাবুল, হেরাত, জালালাবাদ ও মাজার-ই-শরিফ থেকে তড়িঘড়ি কনস্যুলেট বন্ধ করে কর্মী ফিরিয়ে এনেছে।

এখানে অবশ্য দেরি করলে বিপদ বাড়ার আশঙ্কাই ছিল বেশি। কারণ, মার্কিন আমলেই এসব কনস্যুলেটে এর আগেও বেশ ক’বার হামলা করেছিল তালেবানরা।

এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, ভারতের সামনে টেনশনের দিন আছে আরও। আমেরিকা খোলসে মাথা গুটিয়ে নিয়েছে সময় থাকতে। যে কারণে একঘরে হয়ে পড়া ভারত খড়কুটো হিসেবে রাশিয়াকে আঁকড়ে ধরতে চাইলো।

মস্কোর মনোভাবে বোঝা যায়, তাতেও বিশেষ কাজ হবে না। রাষ্ট্রের জনগণ ও সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারত কোন পথে আগাবে? ভেতরে যে সাম্প্রদায়িকতার ভূত উড়ে বেড়াচ্ছে, সেটাকে সামলে একেবারে নাটকীয় কোনও নীতি বেছে নেবে? নাকি তালেবানদের স্বীকৃতি দিয়ে নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আপাতত নিজেদের বারো নম্বর খেলোয়াড় হিসেবে সাইডলাইনে রাখার চেষ্টা করবে? উত্তরে জয়শংকর বলেছেন, ভারত এখন ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ মোডে আছে।  

সূত্র: গ্লোবালটাইমস, এনডিটিভি ও এশিয়াটাইমস অবলম্বনে