পাকিস্তানের ৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের বহুল প্রতীক্ষিত ফলাফল অবশেষে পাওয়া গেছে। তবে এই ফলাফল প্রকাশের পর দেশটিতে চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। নীতি নির্ধারকরা শঙ্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গত ছয় মাসে যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়েছে, নতুন সরকার সেই ধারা অব্যাহত রাখতে পারবে কি না। রবিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন-এর এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভক্ত জনরায় আগামী কয়েক মাস অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। তবে রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয় অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নে স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফেসিলিটেশন কাউন্সিল (এসআইএফসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন, নতুন সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে চাইবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে অন্তত তিন বছরের জন্য অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার আনতে একাধিক কঠোর অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নির্বাচনি প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা ভোটে জয়ী হলে জনগণকে প্রতি মাসে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে সরবরাহ করবে। বাস্তবতার আলোকে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন অসম্ভব। ফলে প্রশ্ন রয়েছে, দলটি আইএমএফ-এর শর্ত মেনে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে কিনা। পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএলএন)ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২০০ ইউনিট বিনামূল্যে এবং ২০-৩০ শতাংশ দাম কমানোর।
এসআইএফসি-এর সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন সব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দৃশ্যমান বেশ কিছু সাফল্যের মধ্যেও একটি ‘অদৃশ্য হাতের’ উপস্থিতির ইঙ্গিত রয়েছে। যা বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীলতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ বলে হাজির হচ্ছে। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে যিনিই আসুন না কেন এই অদৃশ্য হাতের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ রয়ে যাবে। এমনটি মনে করছেন পিডিএম ও পরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব অর্থমন্ত্রী।
সাবেক অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইল বলেছেন, আইএমএফের সঙ্গে নতুন চুক্তি আবশ্যক। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নির্ভর করছে বেসরকারিকরণের মতো কাঠামোগত সংস্কারের ওপর। নতুন জোট সরকারকে মৌলিক অর্থনৈতিক কর্মসূচির বিষয়ে একমত হতে হবে। তিনটি প্রধান দল–পিএমএলএন, পিপিপি ও পিটিআই–কেন্দ্রে জোট সরকার গঠনের জন্য সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যাবে কারা সরকার গঠন করবে।
এই তিনটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহারে আইএমএফের সঙ্গে নতুন চুক্তির কথা উল্লেখ নাই। যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি সেক্রেটারি নুলান্ড ও পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জলিল আব্বাস জিলানি আগস্টে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করেছিলেন। এর মধ্যে আইএমএফের সঙ্গে চলমান আলোচনাও ছিল। অনেক বিশ্লেষক এটিকে ওয়াশিংটনের দৃঢ় বার্তা হিসেবে দেখতে চাইছেন। তারা বলছেন, এতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর হয়ত একটি চুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।
ইশতেহারে তিনটি দলই উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরতা মধ্যে ব্যবহারিক বাস্তবতা অনুধাবনের দাবি রাখে।
পিএমএলএন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ১০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৬০ বিলিয়ন করেছে। পাঁচ বছরে আইএমএফের আভাস ৪০ বিলিয়ন ডলারের কম। গত তিন মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ শতাংশ। পিটিআই-এর সাড়ে তিন বছরের রফতানিতে অর্থনৈতিক প্রণোদনার বেশিরভাগ পুনর্বহাল করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এতে ফলাফল স্পষ্ট।
অতীতে পিএমএলএন-এর নীতিতে রফতানির পরিবর্তনে বাজেটীয় শৃঙ্খলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সংক্ষিপ্ত সময় বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা গহর ইজাজ রফতানির প্রসারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সরকার যদি বিদ্যুতে ছাড় দেয় তাহলে রফতানি হয়ত বাড়তে পারে।
ইজাজ বলেছেন, জোট সরকারের অধীনে রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকা উচিত। এসআইএফসি রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধির নীতি অব্যাহত রাখবে। নতুন ঋণ নিয়ে আগের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না পাকিস্তান। ফলে ভবিষ্যৎ সরকারকে অবশ্যই উৎপাদনমুখী রফতানি বাড়াতে হবে।
কর প্রশাসনে সংস্কার নতুন সরকারের জন্য একটি অগ্রাধিকার থাকবে। পরিসংখ্যান বলছেন, কর ছাড় ও দুর্বল আইন বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৫.৮ ট্রিলিয়ন রুপি বা জিডিপির ৬.৯ শতাংশ। ২০২৭ অর্থবছরের জন্য কর-জিডিপির অনুপাত ২০ শতাংশ বাড়াতে হবে, যা এখন ৮.৫ শতাংশ রয়েছে।
আরেকটি সমস্যা হলো তিনটি রাজনৈতিক দলের রয়েছে অবাস্তব কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা। দেশের ঋণ যখন রাজস্বকে ছাড়িয়ে যায় তখন কর বৃদ্ধি করা প্রয়োজন হয়।
সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. আশফাক হাসান খান মনে করেন, কর সংস্কারে কাঙ্ক্ষিত ফলাফলকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত এবং রাজস্ব বাড়াতে পারে এসআইএফসি। এটি বিনিয়োগকে সহজ করে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় জোর দেয় দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের স্বার্থে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সংঘাতপূর্ণ ও বিভক্ত জনরায় কাম্য নয়।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে পিএমএলএন ও পিপিপির দৃষ্টিভঙ্গিতে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। অনেক ইস্যু কয়েক দশক থেকে অমীমাংসিত। দল দুটিতে বেসরকারিকরণ পরিকল্পনায় সাধারণ ঐকমত্য খুঁজে পেতে পেতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইতোমধ্যে একটি বেসরকারিকরণের কৌশলের উদ্যোগ নিয়েছে।
রাজনৈতিক অভিজাতদের স্বার্থ যা-ই হোক না কেন এসআইএফসি ও অদৃশ্য হাত কাঠামোগত সংস্কারের নেপথ্যে চালিকা শক্তি হিসেবে অব্যাহত রয়েছে।