বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় জড়িত ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার ব্রাঞ্চের ম্যানেজার মাইয়া সান্তো দিগুইতোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে ব্যাংকটি। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত শুনানিতে দিগুইতো দাবি করেছেন, সন্দেহজনক ব্যাংক গ্রাহক কিম ওংকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার খেয়াল রাখতে বলেছিলেন আরসিবিসি’র প্রেসিডেন্ট/সিইও। শুক্রবার ফিলিপাইনের পত্রিকা দ্য ইনকোয়ারার এ খবর জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার সিনেট অধিবেশনের বিরতির সময় আরসিবিসির আইন কর্মকর্তা সেলিয়া ফার্নান্দেজ-এস্টাভিলো জানান, দিগুইতোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও এ লেনদেনে জড়িত থাকতে পারেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমাদের একটি তদন্ত চলছে। কারা কারা এটার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন তাদের একটি তালিকা আছে আমাদের। আমরা দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু বিষয়টি অভ্যন্তরীণ তদন্ত হওয়াতে বিস্তারিত জানানো যাচ্ছে না।
দিগুইতোর ঊর্ধ্বতন কোনও কর্মকর্তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে এ বিষয়ে কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান এস্টাভিলো।
এর আগে ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লরেঞ্জো ট্যান সিনেটে শুনানিতে জানান, ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায় দিগুইতোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তিনটি স্তর রয়েছে। এদের মধ্যে আছেন আঞ্চলিক প্রধান, বিভাগীয় প্রধান এবং ব্যাংকিং ইউনিটের প্রধান।
এস্টোভিলো জানান, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যাংকটি কেওয়াইসি (নো ইওর কাস্টমার, গ্রাহকের সম্পর্কে জানা) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ব্যাংকের তদন্তে দেখা হবে, এই নিয়ম মানা হয়েছিল কিনা।
কেওয়াইসি নিয়ম অনুসারে নতুন ব্যাংক গ্রাহকের নথি ও স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করা হয়।
ব্যাংকটির আইন কর্মকর্তা জানান, যদি দিগুইতো দোষী প্রমাণিত হন তাহলে তার শাস্তি হোক এটা চান তারা।
চুপ থাকতে ব্যাংক কর্মকর্তাকে ৫ মিলিয়ন স্থানীয় ঘুষের প্রস্তাব
বৃহস্পতিবার সিনেট শুনানিতে আরবিসির সংশ্লিষ্ট শাখার সাবেক এক কর্মকর্তা রমুয়ালদো অ্যাগারদো জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাক করা ৮১ মিলিয়ন ডলারের লেনদেন সম্পর্কে চুপ থাকতে ৫ মিলিয় স্থানীয় মুদ্রা ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার দিগুইতো।
শুনানিতে অ্যাগারদো জানান, উইলিয়াম গো নামক অ্যাকাউন্ট থেকে স্থানীয় মুদ্রায় ২০ মিলিয়ন ক্যাশ উত্তোলনের বিষয়টি দেখে ফেলার কারণে দিগুইতো তাকে এ ঘুষের প্রস্তাব দেন। দিগুইতি ওই অর্থ গাড়িতে করে ব্যাংক থেকে নিয়ে যান। ১২ ফেব্রুয়ারি আরেক ব্যাংক কর্মকর্তার ফোর্বস পার্ক হোম এলাকায় এ প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে হত্যার হুমকির বিষয়ে অ্যাগারদো সে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন দিগুইতো তা অস্বীকার করেছেন।
জবানবন্দিতে অ্যাগারদো জানান, ১১ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের হেড অফিস থেকে এ লেনদেন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দিগুইতিকে বিষয়টি জানান। কিন্তু তখন দিগুইতি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করেননি। ওই দিনই ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিটররা আসেন। তখন দিগুইতোর সহকারী টরেস তাকে বলেন, ওই লেনদেনের বিষয়ে অডিটরদের জানালে দিগুইতো বিপদে পড়বেন। ভয়ে তাই তিনি বিষয়টি চেপে যান।
তিনি আরও জানান, এরপর ওইদিন রাতে দেগুইতো তাকে অবসরে যাওয়ার জন্য ৫ মিলিয়ন স্থানীয় মুদ্রা ঘুষের প্রস্তাব দেন। তিনি তাতে রাজিও হন।
ব্যাংকের প্রেসিডেন্টকেও জড়ালেন দিগুইতো
বৃহস্পতিবার শুনানির দ্বিতীয় দিন দিগুইতোকে শুনানিতে ডাকে দেশটির সিনেট কমিটি। শুনানিতে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি দিগুইতো। পরে নির্বাহী অধিবেশন আহ্বান করেন সিনেটররা। সেখানে ওই কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন। সেখানে তিনি জানান, সন্দেহজনক ওই চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুপারিশ করেছিলেন কিম ওং। মানি লন্ডারিংয়ে কিমের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। ৪ মার্চ থেকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে থাকায় শুনানিতে তিনি উপস্থিত হননি।
দিগুইতো কিম ওংকে ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জো ট্যানের বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন। ছয় বছর ধরে কিমকে তিনি চেনেন। ২০০৯ সালেই কিমের সঙ্গে পরিচয় হয় তার।
কিম কেন অ্যাকাউন্ট খোলার সুপারিশ করেছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে দিগুইতো জানান, কিম তাকে ব্যাংকের মার্কেটিং বাজেটের জন্য সহযোগিতা করতে বলেছিলেন। ‘কমন বন্ধু’ জ্যাসন গো’র মাধ্যমে কিমের সঙ্গে তার পরিচয়। ট্যান তাকে জানিয়েছিলেন গো’র কাছ থেকে প্রাইভেট কার কিনছেন কিম।
তবে কিমের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন ট্যান। তিনি জানান, ২০০২ সালে রেস্তোরাঁ মালিক হিসেবে কিমের প্রথম দেখা হয়। এরপর গত ১২-১৪ বছরে দেখা হয়নি। তবে জ্যাসন গোকে চেনার কথা তিনি স্বীকার করেন।
দিগুইতো জানান, ২০১৪ সালের শেষ দিকে জ্যাসনের জন্মদিনে তিনি, ট্যানসহ অন্যরা উপস্থিত হয়েছিলেন। এ সময় ট্যান তাকে কিমের খেয়াল রাখতে বলেন। ২০১৩ সালে ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে পদত্যাগের পর তাকে আরসিবিসিতে যোগদানের আহ্বানও জনান ট্যান।
কিমের জন্মদিনে দিগুইতোর সঙ্গে উপস্থিতির কথা স্মরণ করতে পারেননি ট্যান। দিগুইতোকে আরসিবিসিতে যোগদানের আহ্বানের বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমি তাকে কখনওই বলিনি যোগদান করতে... তিনি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, দেখাতে চেষ্টা করছেন যে, আমিই তাকে ব্যাংকে নিয়ে এসেছি। এটা ঘটেনি।
২৯ মার্চ পর্যন্ত শুনানি স্থগিত
৪ মার্চ থেকে চিকিৎসার জন্য ফিলিপাইনের বাইরে থাকায় সিনেটের শুনানিতে উপস্থিত থাকতে পারেননি কিম ওং। তবে তার আইনজীবী মাসেল ফার্নান্দেজ কমিটিকে জানান, ২০ মার্চের পর শুনানিতে উপস্থিত হবে কিম। আনীত অভিযোগের বিষয়ে কমিটির সামনে কিম নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন।
আইনজীবীর তথ্যের ভিত্তিতে আগামী ২৯ মার্চ দুপুর দেড়টায় শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে। ওইদিন কিম উপস্থিত হবেন কিনা জানতে চাইলে আইনজীবী জানান, কিম উপস্থিত হবেন কিন্তু তা নির্ভর করছে চিকিৎসার ফলাফলের ওপর।
আরও মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত ফিলরেম
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় জড়িত থাকা ফিলিপাইনের মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ফিলরেম সার্ভিসেস ইনকরপোরেটেডের বিরুদ্ধে ১০০ মিলিয়ন পেসো (স্থানীয় মুদ্রা) হংকংয়ে পাঠানোর অভিযোগ ওঠেছে। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট জেজোমার বিনয় ল ফার্ম ফিলরেমের মাধ্যমে ১০০ মিলিয়ন পেসো হংকংয়ের একটি কোম্পানির কাছে পাচার করা হয়েছে। ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল এ বিষয়ে ৬২ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে এ অর্থ পাচার করা হয়।
বৃহস্পতিবার সিনেট কমিটির শুনানিতে রিজার্ভের অর্থ চুরির সঙ্গে জড়িত থাকায় বাংলাদেশে কাছে ক্ষমা চেয়েছে ফিলরেম। এছাড়া এ অর্থ থেকে প্রাপ্ত লাভও ফেরতের ঘোষণা দিয়েছে তারা। তবে অর্থ চুরির কোনও প্রক্রিয়ার সঙ্গে ফিলরেম জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সালুদ বাউতিস্তা। তিনি জানান, পুরো অর্থপাচার প্রক্রিয়ায় ফিলরেমের আয় এক কোটি চার লাখ ৭৪ হাজার ৬৫৪ পেসো। বাংলাদেশি টাকায় তা দাঁড়ায় এক কোটি ৭৬ লাখ এক হাজার ৪৭২ টাকা ৫৪ পয়সা। এই পরিমাণ টাকা যেকোনও মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তরে তৈরি আছে প্রতিষ্ঠানটি।
উল্লেখ্য, হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরো সিস্টেম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি সুইফট মেসেজিং সিস্টেমে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখার ৪টি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন। ফিলিপাইনের ডেইলি ইনকোয়ারার ২৯ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপরই দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। লুট হওয়া অর্থের একটি অংশ উদ্ধারের কথা ৭ মার্চ জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ চুরির ঘটনায় গত ১৫ মার্চ ব্যাংকের যুগ্ম-পরিচালক যুবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে মতিঝিল থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে একটি মামলা করেন। এসব ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। দুজন ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি দেয় সরকার। পরে গভর্নর হিসেবে সাবেক সিনিয়র সচিব ফজলে কবিরকে নিয়োগ দেয় সরকার।
/এএ/