ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি শহর সিনজিল এখন কার্যত একটি ‘বড় কারাগারে’ পরিণত হয়েছে। শহরটির পূর্ব প্রান্তজুড়ে পাঁচ মিটার উঁচু ধাতব বেষ্টনী, ভারী ফটক এবং একমাত্র প্রবেশপথে সেনা চৌকিতে পাহারা বসিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
সন্তানদের নিয়ে বসবাসকারী বায়ান্ন বছর বয়সী মুসা শাবানেহ হতাশার চোখে দেখছিলেন, কীভাবে তার নার্সারির মাঝখান দিয়ে বেড়া বসানো হচ্ছে। এটিই তার জীবিকার একমাত্র উৎস। তিনি বলেন, সিনজিল এখন একটি বড় কারাগারে পরিণত হয়েছে। অবশ্যই, আমাদের এখন নার্সারিতে যাওয়া নিষেধ। আমার যত গাছ ছিল, সব পুড়ে গেছে এবং নষ্ট হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত, তারা আমাদের জীবিকাও কেড়ে নিলো।
ইসরায়েলি বাহিনীর নির্মিত দেয়াল ও চেকপয়েন্টগুলো পশ্চিম তীরের প্রায় ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অনেকে এখন বলছেন, গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। যা শহর ও গ্রামগুলোকে এক স্থায়ী অবরোধের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
সিনজিলের চারপাশে স্থাপিত বেড়া এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা প্রতিবন্ধকতার একটি বিশেষ উদাহরণ। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো সেখানকার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, তারা কাছাকাছি রামাল্লা-নাবলুস মহাসড়ক রক্ষার জন্য এটি তৈরি করেছে।
এক বিবৃতিতে তারা দাবি করেছে, এই এলাকায় বারবার সন্ত্রাসী ঘটনা, একটি প্রধান রুটে পাথর নিক্ষেপ এবং জনশৃঙ্খলা বারবার বিঘ্নিত হওয়া রোধ করতে বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে এই অঞ্চলের বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।
সামরিক বাহিনী আরও বলেছে, যেহেতু বাসিন্দাদের এখনও অবশিষ্ট একমাত্র প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশ এবং বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই এই নীতিকে শহরটিতে ‘মুক্ত প্রবেশাধিকার’ দেওয়ার নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সিনজিলের ডেপুটি মেয়র বাহা ফোকায়া বলেছেন, যারা একসময় আশপাশের জমিতে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা এখন কার্যত বিচ্ছিন্ন। তিনি বলেন, বেড়াটি ৮ হাজার বাসিন্দাকে মাত্র ১০ একর জমির মধ্যে আটকে ফেলেছে। এর ফলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন আশপাশের ২ হাজার একর জমি থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, এটি দখলদার সেনাবাহিনীর এমন একটি নীতি, যা মানুষকে ভয় দেখাতে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ইচ্ছাকে ভেঙে দিতে ব্যবহার করা হয়।
ইসরায়েল বলছে, পশ্চিম তীরে তাদের বেড়া ও প্রতিবন্ধকতা স্থাপন জরুরি। কারণ ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল এই অঞ্চল দখল করার পর থেকে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা রয়েছে, যাদের সুরক্ষা প্রয়োজন।
সিনজিল যে পশ্চিম তীরের অংশে অবস্থিত, সেখানকার ৪৭টি ইসরায়েলি বসতি নিয়ন্ত্রণকারী বিনিয়ামিন আঞ্চলিক কাউন্সিলের প্রধান ইসরায়েল গানৎজ বলেছেন, সিনজিলের বেড়া প্রয়োজন ছিল, কারণ এর বাসিন্দারা কাছাকাছি মহাসড়কে গাড়ির ওপর পাথর এবং মলোটোভ ককটেল নিক্ষেপ করতো।
তিনি আরও বলেন, আরব ফিলিস্তিনিদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি তুলে নিলে ইহুদিদের গণহত্যাকে উৎসাহিত করবে।
বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ ইসরায়েলি ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত অঞ্চলে বাস করছে। বেশিরভাগ দেশ এই ধরনের বসতিগুলোকে জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন বলে মনে করে। ইসরায়েল দাবি করে, এই বসতিগুলো বৈধ এবং ঐতিহাসিক ও বাইবেলীয় ইহুদি সংযোগের কারণে ন্যায্য।
কয়েক দশক আগে ইসরায়েল একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনার কথা বললেও বর্তমানে ইসরায়েলের কট্টর-ডানপন্থি সরকারে এমন প্রভাবশালী বসতি স্থাপনকারী কর্মী রয়েছেন, যারা প্রকাশ্যে পুরো পশ্চিম তীর সংযুক্ত করার দাবি করছেন।
৫২ বছর বয়সী সানা আলওয়ান সিনজিলে থাকেন। তিনি একজন ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তার কথায়, রামাল্লায় পৌঁছাতে একসময় যে অল্প সময় লাগত, এখন সেখানে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত লাগছে। দিনের শুরুতে চেকপয়েন্টগুলোতে কতক্ষণ আটকে থাকতে হয় তা জানার কোনও উপায় নেই। কাজ কমে গেছে, কারণ তিনি আর গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন না। তিনি বলেন, আমাদের জীবনের অর্ধেক পথেই চলে যায়।
গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন পশ্চিম তীর মোটা দাগে রক্ষা পেলেও, এখানকার জীবন ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলে কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে হাজার হাজার শ্রমিকের জীবিকা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি বছরের শুরুতে, উত্তরের জেনিনে জঙ্গিদের ওপর ইসরায়েলি অভিযানের কারণে পশ্চিম তীরের হাজার হাজার বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
জেরিকোতে বেড়ে ওঠা ৩৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ জাম্মুস রামাল্লায় থাকেন। তিনি প্রায় প্রতি সপ্তাহে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতেন। এক ঘণ্টার যাত্রা এখন সাধারণত কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তিনি বলেছেন, এখন সাধারণত মাসে একবারই দেখা করতে পারেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে তাদের বাহিনী জটিল নিরাপত্তা বাস্তবতার মধ্যে কাজ করে এবং ফিলিস্তিনি সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত গতিবিধি নিরীক্ষণ এবং হুমকির প্রতিক্রিয়া জানাতে চেকপয়েন্টগুলো নিয়মিতভাবে স্থানান্তরিত এবং নতুন স্থানে স্থাপন করতে হয়।
ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অধীনে পশ্চিম তীরে সীমিত স্ব-শাসন পরিচালনা করা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের সন্দেহ, অর্থনীতি ও সাধারণ জীবনে শ্বাসরুদ্ধকর প্রভাব ইচ্ছাকৃত। তারা বলছেন, এটি আরও বেশি যুবককে জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যেতে পারে। ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোস্তফা গত মাসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তারা আমাদের জনগণের জীবনকে অত্যন্ত কঠিন করতে সম্ভাব্য সব কিছু করছে।
সূত্র: রয়টার্স