তৃতীয় বছরে গড়ালো ইউক্রেনীয়দের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিনের রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালিয়েছিল। দুই বছর আগের সেই আক্রমণ ছিল ভয়ংকর। দেশ হিসেবে ইউক্রেনকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার সর্বাত্মক রুশ আগ্রাসন ছিল তা। সেসময় ইউক্রেন জাতিকে ধ্বংস করার ভয়ংকর নৃশংসতায় মেতে উঠতে দেখা গেছে রুশ সেনাবাহিনীকে।

যুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই দেখা গেলো, ইউক্রেনের বুচা ও ইরপিন শহর থেকে পিছু হটছে রুশ সেনারা। কিন্তু বিশ্ব সাক্ষী হয়ে রইলো রুশ সেনাবাহিনীর ভয়ংকর বর্বরতার। জানতে শুরু করলো, কীভাবে রাশিয়া আন্তর্জাতিক মানবিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, ইউক্রেনে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সেই সময় বুচার রাস্তায় ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সন্ধান পাওয়া গেছে গণকবরের। এছাড়া রুশ বাহিনীর যৌন সহিংসতা, শিশু অপহরণসহ বিভিন্ন অপকর্মের চিত্র উঠে এসেছিল, যা বছরের পর বছর ধরে বিশ্বকে তাড়িত করবে। 

এই দুই বছরে ইউক্রেনের নাগরিকদের ওপর দিয়ে এক বিধ্বংসী ঝড় বয়ে গেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রুশ আগ্রাসনে এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক শিশুসহ অন্তত ১০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৮ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ। তবে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা যে আরও অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার ওপর এই যুদ্ধ যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, হতাহতের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক কার্যালয়ের অপারেশনস অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ডিভিশনের পরিচালক এডেম ওসোর্নু এক প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ইউক্রেনের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৪.৬ মিলিয়ন মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। দেশের ভেতরেই এক মিলিয়ন শিশুসহ অন্তত ৪ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরছের। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দ্বারে দ্বারে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চাইছে ৬.৩ মিলিয়নের বেশি ইউক্রেনবাসী। 

অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি তো রয়েছেই। এই দুই বছরে ইউক্রেনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এ সময়ে ইউক্রেনের অন্তত ৪ হাজার ৭৭৯টি সাংস্কৃতিক ও পর্যটন সম্পদ বিধ্বস্ত হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মধ্যে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী ভবন ও স্থাপনা যেমন রয়েছে, তেমনি অন্যান্য শিল্পকর্ম ও ভাস্কর্যও রয়েছে।

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, চলমান এ যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে ইউক্রেনের অন্তত ৩.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সাংস্কৃতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এটা আগের বছরের তুলনায় অন্তত ২.৬ বিলিয়ন ডলার বেশি। যুদ্ধ থেমে গেলেও ইউক্রেনের এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অন্তত ১০ বছর লেগে যাবে। আর খরচ হবে ৯ বিলিয়ন ডলার।

তবে এই দুই বছর অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নতুন এক সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের অবকাঠামোগত পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধারের জন্য পরবর্তী দশকে অন্তত ৪৮৬ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এক বছর আগে এই প্রাক্কলন ছিল ৪১১ বিলিয়ন ডলার। 

এছাড়া বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় কমিশন এবং জাতিসংঘের যৌথ উদ্যোগে ইউক্রেন সরকার ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, আবাসিক ভবন বা বসতবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে খরচের যে হিসাব ধরা হয়েছে, তার ১৭ শতাংশ বা ৮০ বিলিয়ন ডলারই খরচ হবে আবাসন খাতে। এরপরই রয়েছে পরিবহন। এই খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ শতাংশ বা ৭৪ বিলিয়ন ডলার। শিল্প ও বাণিজ্য খাতে ৬৭.৫ বিলিয়ন ডলার বা ১৪ শতাংশ, কৃষি খাতে ৫৬ বিলিয়ন ডলার বা ১২ শতাংশ, জ্বালানি খাতে ৪৭ বিলিয়ন ডলার বা ১০ শতাংশ, সামাজিক সুরক্ষা ও জীবনযাত্রা বা জীবিকা নির্বাহ খাতে ৪৪ বিলিয়ন ডলার বা ৯ শতাংশ এবং বিস্ফোরক থেকে তৈরি বিপদ ব্যবস্থাপনা খাতে ৩৫ বিলিয়ন ডলার বা ৭ শতাংশ খরচ হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব বিভাগে শুধু ধ্বংসস্তূপ বা বর্জ্য সরানো বা ব্যবস্থাপনা খাতেই খরচ হবে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার।

রাশিয়ার আক্রমণ শুধু দেশটির জনগণ, সংস্কৃতি বা অবকাঠামোগত ধ্বংসেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং দেশ হিসেবে ইউক্রেন ও ইউক্রেনীয় জাতিকেই নির্মূল করার প্রচেষ্টা। আর পুতিন তার এই প্রচেষ্টাকে লুকিয়ে রাখেননি। যুদ্ধের দুই বছর পর, লড়াই আর নৃশংসতা ছাড়িয়ে সেই প্রচেষ্টা অন্য কিছুতে স্থানান্তরিত হচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।   

রাশিয়ার এই আক্রমণ ইউক্রেনের মানুষের কাছে এক জীবন্ত বাস্তবতা। কারণ এখনও তাদের যুদ্ধের সাইরেনের শব্দে ঘুম ভাঙে। চোখের সামনে তারা শত শত মানুষকে মরতে আর জখম হতে দেখছে। প্রতিটি দিন তারা এক ধরনের মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছে।

এটি ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার প্রথম হামলা নয়। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের আক্রমণসহ সব ধরনের নৃশংসতা মোকাবিলার ব্যর্থতা থেকেও শিক্ষা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাচ্ছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

ইউক্রেনীয়রা লড়াই করছে তাদের জাতিগত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। জীবন বাজি রেখে লড়াই করছে দেশকে বাঁচানোর জন্য, টিকে থাকার জন্য। কিন্তু এটা কি শুধু তাদের নিজ দেশকে বাঁচানোর লড়াই, নাকি পুরো বিশ্বের জন্যও! ইউক্রেন ও পশ্চিমারা বলছে, এটি ইউরোপ তথা গণতান্ত্রিক বিশ্বকে রক্ষার লড়াই। আর তাই দেশটিকে সব ধরনের সহায়তা করা প্রয়োজন।

সূত্র: ফোর্বস