রাশিয়ার আভদিভকা দখল, পাল্টে যাবে যুদ্ধের গতি?

চলতি মাসেই ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জেনারেল ওলেক্সান্ডার সিরস্কি। সে সময় নতুন এই সেনাপ্রধান বলেছিলেন, জীবন বিসর্জন দেওয়ার চেয়ে পিছু হটা ভালো। আর শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় আভদিভকা শহরে তিনি সেটাই করে দেখালেন।

‘জীবন রক্ষার জন্য আভদিভকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের’ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। 

আভদিভকা দখলের জন্য, রুশদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও, চার মাসের নিরলস আক্রমণ তাদের এই বিজয় এনে দিয়েছে। আর ইউক্রেনের সেনা সংখ্যা কমে গেছে। এমনকি বন্দুক আর গোলাবারুদও কমেছে।

ফলে গত বছর ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর, এটিই মস্কোর সবচেয়ে বড় জয়। এর আগেও, ২০১৪ সালে আভদিভকার সাময়িক দখল নিয়েছিল রাশিয়া। তবে তা পুনরুদ্ধার করে ইউক্রেন।

তাহলে যুদ্ধের দুই বছর পর আভদিভকার পতনের অর্থ কী?

আভদিভকার পতনের পর, এখন ইউক্রেন ও রাশিয়ার পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাশিয়ার জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৪০ লাখ। যা ইউক্রেনের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি। তাই যুদ্ধে হাজার হাজার সেনা হারানো সত্ত্বেও দ্রুতই সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারে রাশিয়া।

রাশিয়ার মতো না হলেও, যুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু তারা দ্রুতই সেই সংখ্যা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।

আর তাই প্রায় ধ্বংস হওয়া একটি শহরের দখল নিতে পেরেছে রাশিয়া। সেখানে মোতায়েন ইউক্রেনের থার্ড অ্যাসল্ট ব্রিগেড বলেছে, রুশ পদাতিক বাহিনী চারদিক থেকে আক্রমণ করেছে।

শহরটির দখল নেওয়ার জন্য এই অঞ্চলে সবচেয়ে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। শুধু তাই না, ইউক্রেনের ঘাঁটিগুলোতে প্রতিদিন ৬০টি করে বোমা ফেলছে তারা।

শেষবার যখন রুশ সেনারা ইউক্রেনীয় শহর বাখমুত দখল করেছিল, তখন দীর্ঘসময় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সিরস্কি। প্রতীকী বিজয়ের জন্য অনেক বেশি সেনার প্রাণহানি ও অপ্রয়োজনীয় হতাহতের জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আভদিভকায় তার সেই অভিজ্ঞতার পরিবর্তন হয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

তবে রাশিয়ার এই জয় রাতারাতি আসেনি। গত অক্টোবর থেকে আভদিভকা দখলে করে আক্রমণ চালিয়ে আসছে মস্কো। ইউক্রেনীয় সেনারা দীর্ঘদিন তাদের অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল। ডনবাসে রুশ সেনাদের পাশাপাশি, সাঁজোয়া যানও ধ্বংস করেছিল। অবশেষে, ইউক্রেনের দুর্গ বলে পরিচিত শহরটির দখল নিতে পেরেছে রাশিয়া। তাদের এত সময় লাগার কারণ, গত ১০ বছরে এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করেছিল ইউক্রেন। 

ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর তৃতীয় অ্যাসল্ট ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার মেজর রডিয়ন কুদ্রিয়াশভ বলেন, রাশিয়া কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। শুধু সুকৌশলে পরিচালিত যুদ্ধে একটি লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে তারা। তিনি বলেন, আসলে এখানে রাশিয়ার সাত সেনার বিরুদ্ধে এক ইউক্রেনীয় সেনা যুদ্ধ করেছে।

তবে এখনও আত্মবিশ্বাসী রডিয়ন কুদ্রিয়াশভ। তার মতে, পোকরোভস্ক ও কোস্ত্যন্তিনিভকার মতো শহরের দিকে আর এগোতে পারবে না রুশ বাহিনী। তবে সেটিও তেমন নিশ্চিত নয়। তবে তারা যা করতে পারে, সেটি হলো ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার দখলে থাকা ডনেস্ক শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার পূর্ব দিকে আক্রমণ জোরদার করতে পারে।

২০২২ সালের গ্রীষ্মে, ইউক্রেনকে আরও একবার পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেছে রাশিয়া। লাইসিচানস্ক ও সেভেরোডোনেটস্কের মতো শহর ঘিরে রেখেছিল রুশ বাহিনী। তাদের আগ্রাসন থামাতে তেমন কিছুই করতে পারেনি ইউক্রেনীয়রা।

যাই হোক, পরে পশ্চিমা অস্ত্র ও সামরিক সহায়তায় ওই বছরের শেষের দিকে একটা পরিবর্তন আসে। সেসময় খেরসন ও খারকিভ অঞ্চল রুশ সেনা মুক্ত করে ইউক্রেনীয় বাহিনী।

কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এখন ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। কারণ বৈশ্বিক রাজনীতি যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে।

পশ্চিমা সাহায্যের তালবাহানাই আভদিভকার দখলের মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও অন্যান্য মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনকে সাহায্য করার জন্য কাজ করছে। তারপরও ইউক্রেনের জন্য  ৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ এখনও অনুমোদন দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।

ফলে ইউক্রেনীয়দের গোলাবারুদ ও অস্ত্রের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে। মনোবল ভেঙে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে আভদিভকার পতন তো বটেই, পুরো কিয়েভ থেকেই পিছু হটতে হতে পারে ইউক্রেনের সেনাদের।

কারণ এখনও পুরো ইউক্রেনের দখল চান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আর তার পক্ষে এটি করা এখনও সম্ভব। এই সম্ভাবনাই রুশ সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধে, পশ্চিমাদের একতা ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারে। আবার ইউক্রেন এই যুদ্ধে কখনোই জয়ী হতে পারবে না, এমন সংশয়কেও উসকে দিতে পারে।

সূত্র: বিবিসি