সত্যিই কি পশ্চিমবঙ্গের জনতত্ত্ব বদলে দিচ্ছে ‘অবৈধ বাংলাদেশিরা’?

ভারতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চলছেই। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে শপিং মল, অফিস থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশনের প্রাইম টাইম থেকে শুরু করে রাজপথে বিক্ষোভ ‘আলোচনা’ সব জায়গাতেই। এই বিতর্কের মূলকেন্দ্রে রয়েছে, লাখো বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার জনতত্ত্ব আমূল পাল্টে দিচ্ছে। ভারতীয় সমাজের একাংশ দৃঢ়ভাবে এই কথাটি বিশ্বাস করে এবং দাবি করে, অবৈধ অভিবাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে ভোট ব্যাংক রাজনীতির কারণে। সমাজের আরেকটি অংশ যারা মানুষের ধর্ম ও দেশের বিরোধিতা করেন না, তারাও মনে করেন অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। যদিও সত্য উন্মোচনের আগে এতে প্রাধান্য পাচ্ছে বিকল্প তথ্য।

india-bangla-border

সম্প্রতি আসা ‘বাংলাদেশি অভিবাসী’দের সংখ্যা

লাখো অবৈধ অভিবাসীর বিষয়ে মানুষের সাধারণ লোকজ্ঞানের ভিত্তি হলো অজানা প্রমাণ এবং ‘জানা গেছে...’, ‘ওই সবজি বিক্রেতা এসেছে...’, ‘সীমান্ত এলাকায়...’ ইত্যাদি শোনা কথা। বিশ্বাস ও মত পরিবর্তন করা খুব কঠিন যখন তা তথ্য দ্বারা প্রমাণিত হয় না। এক্ষেত্রে করণীয় হলো হাইপোথিসিস যাচাই করা। তথ্য সংগ্রহ, পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি হাইপোথিসিস তৈরি করে তা সঠিক না ভুল সেই উপসংহারে আসা।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই হাইপোথিসিস হলো: গত কয়েক দশকে যদি ‘বাংলাদেশি অভিবাসী’ (মুসলিম/হিন্দু) বড় সংখ্যায় প্রবেশ করে এবং রেশন কার্ড ও ভোটার কার্ড পেয়ে থাকে, তাহলে রাজ্যের জনসংখ্যা আকাশচুম্বি হওয়ার কথা এবং দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় জনসংখ্যা প্রবণতা আলাদা হবে। এনএফএইচএস কর্তৃক সর্বশেষ আদমশুমারি ও জরিপ কী বলে?  

Capture

১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্যে দেখা গেছে, ১৯৯০ দশক থেকে পুরো দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে জন্মহার উল্লেখযোগ্য হারে কম। এটি শুধু যে পুরো জনসংখ্যার ক্ষেত্রে সত্য তা নয়, হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মালম্বী মানুষের মধ্যে জন্মহার কমছে গত ২-৩টি শুমারিতে।

১৯৮১-৯১ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে জন্মহার ছিল ২১ দশমিক ১ শতাংশ, ১৯৯১-২০০১ সালে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০০১-২০১১ সালে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্মহার ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ (১৯৮১-৯১), ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ (১৯৯১-২০০১) ও ২১ দশমিক ৮ শতাংশ (২০০১-২০১১)।

অন্যভাবে বললে, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের চেয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে কম ভূমিকা রাখছে, অন্তত ১৯৯১ সাল থেকে হিন্দু এবং ২০০১ সাল থেকে মুসলিমরা। জাতীয় জন্মহারের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে জন্মহার হার কম। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে পশ্চিমবঙ্গে ‘বাংলাদেশি অভিবাসীদের’ কারণে যে জনসংখ্যা বাড়ছে তা কল্পকথা ছাড়া কিছুই না।

সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে অবৈধ অভিবাসী

বলা হতে পারে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য আরও মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে। এসব জেলার সীমান্ত দিয়েই তো অভিবাসীরা প্রবেশ করে। তবে এসব জেলার আদমশুমারির তথ্যে এমন কোনও প্রবণতা উঠে আসেনি। অধ্যাপক সুভনিল চৌধুরী ও শাশ্বত ঘোষ জনসংখ্যা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, গত দশকের তুলনায় ২০০১-২০১১ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের সবগুলোর জেলাতেই জন্মহার কমেছে। হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মালম্বীদের ক্ষেত্রে এটি সত্য। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কোনও ধারাবাহিক প্রবণতা পাওয়া যায়নি যাতে বিপুল সংখ্যায় অভিবাসীদের প্রবেশ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।

Capture1

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী তিনটি জেলা উত্তর দিনাজপুর, মালদা ও মুর্শিদাবাদে পশ্চিমবঙ্গের গড় জন্মহারের চেয়ে বেশি। কিন্তু সীমান্তবর্তী অপর চারটি জেলার (দক্ষিণ দিনাজপুর, নদিয়া, কুচ বিহার , উত্তর ২৪ পরগনা) চেয়ে কম। ভেতরের জেলাগুলোর মধ্যে পুরুলিয়া, মেদিনিপুর, বীরভূমে গড় জন্মহারের বেশি এবং হুগলি বর্ধমানে কম হার রয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হিন্দু-মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্মহার সমান্তরাল। যেখানে হিন্দুদের জন্মহার বেশি, সেখানে মুসলমানদেরও বেশি। আবার যেখানে হিন্দুদের কম, সেখানে মুসলিমদের জন্মহারও কম। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কোথাও হিন্দুদের জন্মহার বেশি নেই, বেশি মুসলমানদেরও। ফলে এই আদমশুমারির তথ্যে পশ্চিমবঙ্গে বিপুল সংখ্যায় অভিবাসীদের প্রবেশের কোনও প্রবণতা পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কি জনসংখ্যা আধিক্য?

খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে বাংলাদেশের মধ্যে জন্মহার সবচেয়ে কম। এতে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশ পরিকল্পিতভাবে তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এমনকি তা ভারতের জন্মহারের চেয়ে কম। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসীদের প্রবেশও কমেছে।  

অনিবন্ধিত অভিবাসীদের ভোটার, রেশন ও আধার কার্ড যদি না থাকে?

কোনও যুক্তিতেই প্রতীয়মান হয় না যে, লাখো অভিবাসী ভোট ব্যাংক রাজনীতির কারণে প্রবেশ করবে তাদের ভোটার কার্ড দেওয়া হবে না। ২০১৯ সালের জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক প্রতিবেদন অনুসারে, বিদেশে জন্ম নিয়ে ভারতে বসবাসকারী অভিবাসীদের সংখ্যা ৫১ লাখ। ২০০০ সালের ৬৪ লাখ ও ১৯৯০ সালের ৭৬ লাখের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসীদের সংখ্যা ১৯৯০ সালে ৪৩ লাখ ৭০ হাজার হলেও ২০১৯ সালে তা কমে এসেছে ৩১ লাখে। ১২০ কোটি জনসংখ্যার ভারতে ৩০ লাখ খুব বড় পরিবর্তন! প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হলো সম্প্রতি অভিবাসীদের আগমণ কমে যাওয়া ও বয়সজনিত কারণে আগের অভিবাসীদের মৃত্যু।

বাংলাদেশি অভিবাসীরা যাচ্ছে কোথায়?

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০০০ সালে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১ লাখ ৪৯ হাজার ও হাজার। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার ও ২ লাখ ৪৫ হাজারে। সৌদি আরবে ২০০০ সালে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখের মতো। এখন সেখানে এই সংখ্যা ১২ লাখের বেশি।

সত্যিই কি মুসলিমরা একাধিক বিয়ে করছে বেশি সন্তান নেওয়ার জন্য?

একটি বহুল প্রচলিত ধারণা হলো ‘হাম পাঁচ, হামারে পঁচিশ’ (আমি পাঁচ, আমাদের পঁচিশ)। এর মধ্যে বুজানো হয় বেশিরভাগ মুসলমানের ৩-৪ জন স্ত্রী আছে এবং বেশি করে সন্তান নেওয়ার জন্য একাধিক বিয়ে করে তারা। এক্ষেত্রে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়া জ্ঞান দিয়েই এই মিথ গুড়িয়ে দেওয়া যায়। মানবজাতির স্বাভাবিক লিঙ্গের অনুপাত ১:১। মানব প্রজনন যে প্রক্রিয়ায় কাজ করে সেই ভিত্তিতেই এই অনুপাত।

ফলে বেশিরভাগ পুরুষের পক্ষে একাধিক বিয়ে করা অসম্ভব। ধরা যাক, ১ হাজার মানুষের (৫০০ নারী ও ৫০০ পুরুষ) মধ্যে ১০০ পুরুষ প্রত্যেকে তিনজন নারীকে বিয়ে করছেন। ফলে ওই সমাজে ৪০০ অবিবাহিত পুরুষ থাকবে কিন্তু অবিবাহিত নারী থাকবে মাত্র ২০০ জন। ফলে অনেকেই বিয়ে করার মতো পাত্রী খুঁজে পাবেন না এবং তাদের কোনও সন্তান থাকবে না। প্রভাব পড়বে পুরো জনসংখ্যার জন্মহারে। সার কথা হলো, এমন চমৎকার উপায়ে জনসংখ্যা বাড়ানোর উপায় বৈজ্ঞানিকভাবে অবাস্তব।

শেষ কথা

দেশভাগ ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যে অভিবাসীরা ভারতে আসেনি তা নয়। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসীদের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে জনতত্ত্বে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেনি। বরং পরিসংখ্যানে সফলতার কথা উঠে আসছে জন্মহার নিয়ন্ত্রণে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। সূত্র: দ্য ওয়্যার।