বাংলাদেশের পাটে আবারও ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি 

ভারতের পাটকল মালিকদের প্রবল চাপের মুখে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ওপর আবারও চড়া হারে অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি (কর) বসালো ভারত সরকার। গত বছরের শেষ দিন (৩০ ডিসেম্বর, ২০২২) দিল্লিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে যে সব পাটজাত পণ্য ভারতে রফতানি হবে তাতে পণ্যের প্রকারভেদে মিটারপিছু সাড়ে ৬ ডলার থেকে সাড়ে তিনশো ডলার শুল্ক আরোপিত হবে– আর এটা জারি থাকবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য। 

নেপাল থেকে ভারতে পাটজাত পণ্য আসে অতি সামান্যই, ফলে এই সিদ্ধান্ত যে মূলত বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এই শুল্ক তুলে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়ে আসছে, কিন্তু তারপরও ভারত আরও পাঁচ বছরের জন্য অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি বহাল রাখার ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে অবধারিতভাবে।  

শেখ হাসিনার বিগত সরকারে তোফায়েল আহমেদ যখন বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই বাংলাদেশ বারেবারে পাটজাত পণ্যের রফতানিতে ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার (শুল্ক ও অশুল্ক বাধা)-গুলো হঠানোর জন্য ভারতের কাছে তদবির চালিয়ে আসছে। ২০১৯-এ শেখ হাসিনার নতুন সরকারে টিপু মুন্সী বাণিজ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও সে প্রচেষ্টা অব্যাহত থেকেছে, কিন্তু তারপরও ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তে প্রমাণিত যে তারা বাংলাদেশকে পাট রফতানিতে আপাতত কোনও ছাড় দিতে রাজি নয়। 

প্রসঙ্গত, গত ২২ ডিসেম্বরই দিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী, যথাক্রমে পীযূষ গোয়েল ও টিপু মুন্সীর মধ্যে সর্বাত্মক আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে এই মুহূর্তে ‘সেপা’ নামে যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের কথাবার্তা চলছে, সেটা নিয়েও দুই বাণিজ্যমন্ত্রী বিশদে আলোচনা করেছেন এবং ‘সেপা’ যে দ্রুত সম্পাদন করা দরকার সে বিষয়েও একমত হয়েছেন। 

দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীদের বৈঠক। ২২ ডিসেম্বর, ২০২২

অথচ সেই বৈঠকের পর সপ্তাহ ঘুরতে না-ঘুরতেই ভারত যেভাবে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ওপর অত্যন্ত চড়া হারে অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি নতুন করে জারি করলো, তা বাণিজ্যিক মহলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেককেই বেশ বিস্মিত করেছে। 

ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনের কাছে আজ স্বীকার করেছেন, ভারতের পাটকল মালিকদের সমিতির (ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন বা আইজেএমএ) চাপের মুখেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  

বস্তুত গত ৫ মে আইজেএমএ এক বিবৃতিতে পরিষ্কার বলেছিল, বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ওপর যদি অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি না-থাকত তাহলে ভারতের পাট তথা চটকল শিল্প (যা মূলত পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক) এতদিনে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। ২০১৭ সাল থেকে চালু হওয়া এই ডিউটি বহাল রাখার জন্য মাসকয়েক আগের ওই বিবৃতিতে জোরালো সওয়াল করেছিল তারা।  

ভারতের একটি বাণিজ্যমেলায় আইজেএমএ-র স্টল

আইজেএমএ-র পরিচালনা কমিটির একজন সিনিয়র সদস্য উৎকর্ষ কানোরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে এদিন বলছিলেন, ‘ভারত সরকার যদি চায় এদেশের পাটশিল্প টিঁকে থাকুক তাহলে এই অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি বসানো ছাড়া কোনও উপায় নেই।' 

'এই ডিউটি থাকা সত্ত্বেও ভারতে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের রফতানি গত কয়েক বছর ক্রমশ বেড়েছে, কারণ বাংলাদেশ সরকার তাদের ইয়ার্ন, চটের ব্যাগ বা হেসিয়ান ফেব্রিক সব কিছুর ওপরেই ভর্তুকি বা ক্যাশ সাবসিডি দিচ্ছে। ফলে আমাদের ব্যবসায় টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে উঠছে’, বলছিলেন উৎকর্ষ কানোরিয়া। 

একটা সরকার যখন তার নিজের দেশে উৎপাদিত পণ্যর রফতানি পথকে প্রশস্ত করতে তাতে নানাভাবে ভর্তুকি দেয়, সেটাকেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিভাষায় বলে ডাম্পিং। আর সেই ‘সস্তা’ পণ্যের হাত থেকে দেশজ পণ্যকে রক্ষা করতে আমদানিকারী দেশ যখন বিদেশের সেই পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক বসায়, সেটাকেই বলে অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি।  

কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশ যখন নিজেদের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে, তখন এই অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটির মেয়াদ বাড়ানোর পদক্ষেপ যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।