কংগ্রেস-সিপিএম জোটের ভাবনার পেছনে অংক

সেই হিসেবেও মমতাই ফের ক্ষমতায়

কংগ্রেস-সিপিএমতৃণমূল থেমে যাচ্ছে ১২৬ আসনে, বিজেপি পাবে ৪টে, বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ৩। আর ১৬১টা আসন ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে পেয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে চলেছে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোট! পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মোট আসন সংখ্যা ২৯৪। অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো বটেই, কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোট তার চেয়ে ডজন খানেকেরও বেশি আসন পাচ্ছে!
কোনও প্রাক-নির্বাচনি সমীক্ষা নয়, নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র ওমপ্রকাশ মিশ্র দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে সম্প্রতি যে চিঠি লিখে কংগ্রেস-সিপিএম জোটের পক্ষে সওয়াল করেন, তাতেই এই হিসেবটি দেওয়া আছে। ওমপ্রকাশবাবু শুধু একজন পুরনো কংগ্রেসিই নন, তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক জন সম্মাননীয় অধ্যাপকও বটে। কাজেই, নিছক ভাবাবেগ নয়, যুক্তি, বিশ্লেষণ ও হিসেবের ভিত্তিতেই তিনি দলের হাইকমান্ডের কাছে তার হিসেব পেশ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক এবং ওমপ্রকাশবাবু সেটাই করেছেন।
কিন্তু এক্ষেত্রে যুক্তি ও বিশ্লেষণের মানদণ্ডটা কী?
এই হিসেবে প্রধানত ধরে নেওয়া হয়েছে, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে প্রবল ‘মোদি হাওয়া’-য় এই রাজ্যে বিজেপি যত ভোট পেয়েছিল, তার অন্তত ৪০ শতাংশ কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোটের দিকে চলে আসবে এবং তাতেই বাজিমাত করবে অতীতে পরস্পর যুযুধান থাকা এই দু’পক্ষের বর্তমান সম্ভাব্য নির্বাচনি আঁতাত।

বস্তুত, ভারতে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে চতুর্মুখী লড়াই হয়েছিল। ওই ভোটে ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’-র ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ, চার রাজনৈতিক পক্ষ- তৃণমূল, বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও বিজেপি ‌লড়েছিল আলাদা আলাদাভাবে। কেউ কারও জোট বা প্রাক নির্বাচনি সমঝোতায় যায়নি। সেবার আসমুদ্র হিমাচল ভারতের জনাদেশ মোটামুটিভাবে নরেন্দ্র মোদির পক্ষে গিয়েছিল। মমতা এই রাজ্যের মোট ৪২টা আসনের মধ্যে ৩৪টা পেয়ে তার গড় অটুট রাখলেও ২টো আসন জিতে নেয় বিজেপি, অনেকটা ওই মোদি হাওয়ার কারণেই। বহু আসনে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে চলে আসে। কংগ্রেস জেতে ৪টেতে আর বামফ্রন্ট ২টোয়। ভোট শেয়ার দেখা যায়, তৃণমূল পেয়েছে ৩৯ শতাংশ, বামফ্রন্ট ৩০, কংগ্রেস ১০ এবং বিজেপি ১৭ শতাংশ। বিধানসভাওয়ারি ফল হিসেব করে দেখা যায়, তৃণমূল এগিয়ে ২১৪টা, বামফ্রন্ট ৩১, কংগ্রেস ২৯ আর বিজেপি ২০টা আসনে।

জোট করতে ইচ্ছুক কংগ্রেস এবং সিপিএম দু’দলের নেতাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, প্রবল মোদি হাওয়ায় বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে একক লড়ে ২০১৪-তে ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ওটাই এই রাজ্যে এখনও পর্যন্ত বিজেপি-র সেরা ফল। এখন কিন্তু মোদি হাওয়া অনেকটাই ফিকে। ‘আচ্ছে দিন’ বা আর্থিক সুদিন এখনও আসেনি। তা ছাড়া, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ‘অসহিষ্ণুতা’ নিয়ে বিজেপি ও মোদি সরকারের প্রতি দেশের একটা বড় অংশ বিরূপ। তা ছাড়া, ২০১৪-রটা ছিল লোকসভা নির্বাচন, কেন্দ্রে ক্ষমতায় কে বসবে, তার ভোট। এই রাজ্যের শাসনক্ষমতায় তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে বিজেপি সুযোগ পেয়েও পুরোপরি ব্যর্থ। কাজেই, মমতাবিরোধী ভোটের বেশির ভাগটাই বিজেপি’র দিকে না গিয়ে যাবে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের দিকে, আর সেই ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সুযোগ নিয়ে মমতা যাতে ফের কেল্লা ফতে করতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করতেই জোট প্রয়োজন। জোটে ইচ্ছুক আলিমুদ্দিন স্ট্রিট (রাজ্যে সিপিএমের সদর কার্যালয়) ও বিধানভবন (প্রদেশ কংগ্রেসের সদর দফতর)-এর নেতারা ভাবছেন, দু’দলের প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট তো থাকবেই আর সেইসঙ্গে বিজেপি-র সেই ১৭ শতাংশ ভোটের ৪০ শতাংশ তাদের দিকে স্যুইং করলেই মমতার ক্ষমতায় ফেরা আটকানো যাবে।

কিন্তু যেসব যুক্তি পর পর সাজিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে, তাতেই গলদ আছে যে!

প্রথম কথা, জোটের কথা ভাবা মানেই অংক মাথায় রাখা। কিন্তু কংগ্রেস-সিপিএম জোটের প্রবক্তারা সম্ভবত অংকের কেবল বাইরেটা দেখাচ্ছেন, অন্দরমহলটা গোপন করে যাচ্ছেন। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে চার দলের ভোট শেয়ার একটু তলিয়ে দেখলে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, দক্ষিণবঙ্গে অর্থাৎ তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বলে যা পরিচিত এবং মোট ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে রাজ্যের যে প্রান্তে আসন সংখ্যা ২১৮, সেই জায়গায় তৃণমূলের ঝুলিতে এসেছিল ৪৪.১৭ শতাংশ ভোট। বামফ্রন্ট ৩০.৬৬ আর কংগ্রেস ৫.৩৯ শতাংশ। বিজেপি পেয়েছিল ১৬ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ বিজেপি-র প্রাপ্ত ওই ভোটের ৪০ শতাংশ কংগ্রেস-বামফ্রন্টের অনুকূলে স্যুইং করলেও তৃণমূলের দুর্গে আঁচড় কাটা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে শুধু দক্ষিণবঙ্গের জোরেই খেলা শেষ করে দিতে পারে তৃণমূল।

২০১৪-র ভোটের অংকের হিসেব মাথায় রাখলে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোট তৃণমূলকে বেগ দিতে পারে মধ্য ও উত্তরবঙ্গে। কারণ, দু’বছর আগের সেই ভোট শেয়ার অনুযায়ী, রাজ্যের ওই প্রান্তে বামফ্রন্টের ভোট আছে ২৭.৫২ শতাংশ- যা সবার চেয়ে বেশি। দ্বিতীয় স্থানে তৃণমূল, ২৬.৩৫ শতাংশ ভোট নিয়ে। তৃতীয় স্থানে থাকা কংগ্রেসের ভোট ২২.৭ শতাংশ। সবশেষে বিজেপি, যে দলের ভোট ১৮ শতাংশ।

জোটের প্রবক্তারা যেটা বলছেন না, তৃণমূল কিন্তু ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে মধ্য ও উত্তরবঙ্গে ছিল তিন নম্বর জায়গায়। ক্রমশ মমতার দল কংগ্রেসের কাছ থেকে ওই জায়গাটা ছিনিয়ে নিয়েছে মূলত কংগ্রেস ভাঙিয়ে। ২০১৪-র পরে দিনকে দিন কংগ্রেস দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে, তৃণমূল তার শক্তি কমিয়ে দেওয়ায়। যেমন, জলপাইগুড়ি ভেঙে নতুন জেলা আলিপুরদুয়ারে জেলা পরিষদের সভাধিপতি হলেন তৃণমূলের। কিন্তু কে তিনি? কালচিনি এলাকার বহু পুরনো কংগ্রেস নেতা মোহন শর্মা। তেমনই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর নিজের জেলা মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের দলীয় জেলা সভাপতির নাম মান্নান হোসেন। কংগ্রেসেরই এক সময়ের সাংসদ ও অধীরের ঘোর বিরোধী। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির নিজের জেলাতেও গত দু’বছরে কংগ্রেসকে কিছুটা হীনবল করেই তৃণমূল শক্তিশালী হয়েছে।

অথচ দক্ষিণবঙ্গে নতুন করে কংগ্রেস মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।

সিপিএম তথা বামফ্রন্টের বিভিন্ন কর্মসূচিতে, মিটিং-মিছিলে লোক হচ্ছে। সিপিএমের শরীরে-মনে বল এসেছে, সত্যি কথা। কিন্তু এ টুকুই তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য যথেষ্ট কি?

আর এক সময়ে রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা সেই সিপিএমের প্রতি আজন্ম ঘৃণা লালন করে রাখা কোনও কংগ্রেস সমর্থক কি কাস্তে-হাতুড়ি-তারায় ভোট দেবেন? তেমনই কংগ্রেসকে চিরকাল শত্রু ও শোষক বলে জেনে আসা বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের সিপিএম কর্মী হাত চিহ্নের প্রার্থী হয়ে খাটবেন তো?

অস্বীকার করা যাবে না, মমতার আমলে অপশাসন আছে, দুর্নীতি আছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির খারাপ হওয়া আছে, মুখ্যমন্ত্রীর অবিবেচক মন্তব্য আছে, শাসক দলের দাদাগিরি আছে, তোলাবাজি আছে। অন্য দিকে, রাজ্যে ভারী শিল্প নেই, চাকরি নেই, সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ্য ভাতা বা ডিএ প্রচুর বকেয়া।

কিন্তু সেই সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতা থেকে হটানোর হাওয়াটাও নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত।

/এএইচ/