ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক দশকের শাসনামলে দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের অধিকার ক্রমশ কমে আসছে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) মুসলিমবিরোধী বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশটির একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করেছে মোদি সরকার। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে নির্মিত হয়েছে রামমন্দির। একাধিক রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মুছে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে মুঘল আমলের বিভিন্ন নাম ও স্মৃতিচিহ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে হিসেবে সেখানকার মুসলিমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় মেয়াদে মোদি ক্ষমতায় এলে বিভাজন আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংখ্যার দিক দিয়ে তৃতীয় মুসলিম প্রধান দেশ ভারত। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পর, ভারতেই সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস। ১৪৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু। দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা ২০ কোটি ও হিন্দু জনসংখ্যা ১১৫ কোটি।
এক দশক আগেও সেখানকার মুসলিমরা নিজেদের ভারতীয়ই মনে করত। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তারা হিন্দু-মুসলিমরা পাশাপাশি মিলেমিশেই থাকত। হিন্দুদের পালা-পার্বনে, পুজা-আর্চনায় মুসলিমরাও সামিল হতেন। আবার মুসলিমদের ঈদ আনন্দসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দুদের অংশগ্রহণও ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। দিল্লির উপকণ্ঠে দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী ও চার মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন জিয়া-উস সালাম। পেশায় তিনি ভারতের অন্যতম দৈনিক পত্রিকার একজন চলচ্চিত্র সমালোচক। স্ত্রী উজমা আউসফও সাংবাদিক হিসেবে জীবনযাপন, খাদ্য ও ফ্যাশন সম্পর্কে লিখতেন। সালাম বলেন, একটা সময় ছিল যখন সিনেমা, শিল্প, সংগীতে জীবনটা পরিপূর্ণ ছিল। আড্ডা হত, গান হত, আলোচনা-সমালোচনা সবই হত। অফিস শেষে শুধু প্রিয় একটা খাবার খাওয়ার জন্য পুরনো এক বন্ধুর মোটরসাইকেলের পিছনে বসে দূরের একটা স্টলে যেতাম আমরা। সেখানে আরও কয়েকজন বন্ধু আসত। চাকরির ক্লান্তি কেটে যেত সেই আড্ডায়।
আর এখন? ৫৩ বছর বয়সী সালাম বলেন, এখন প্রাণহীন জীবন কাটাচ্ছি। অফিস আর বাসা, বাসা আর অফিস; এর মধ্যেই জীবন আটকে গেছে। এখন আর আড্ডা হয় না। কারণ এখন প্রতি মুহূর্তে নিজের মুসলিম পরিচয়টা নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কী ব্যাংকে, কী পার্কিং লট, এমনকি যাত্রীবাহী ট্রেনেও। মুসলিমদের জন্য সব কিছু আলাদা হয়ে গেছে।
সালাম আরও বলেন, এখন ভীষণ চিন্তা হয়, দুশ্চিন্তা। কীভাবে মেয়েদের সঠিকভাবে বড় করে তুলবো? যে দেশে মুসলিম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, এমনকি মুসলিম পরিচয়টাকেই মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়, মুসলিমদের ভারতীয় পরিচয়টাই নাই করার চেষ্টা চলছে যে দেশে; যেখানে মুসলিমরা কী খাবে, কী পোশাক পরবে, কী চিন্তা করবে তাও নির্ধারিত।
ক্ষোভ নিয়ে সালাম বলেন, কেমন লাগবে আপনার, যখন আপনি জানেন যে, আপনার দেশের নেতারাই আপনাকে চায় না। দীর্ঘদিনের বন্ধু এখন আর আগের মতো নেই। প্রতিবেশীদের পালা-পার্বনে আর ডাক পড়ে না। সুখে-দুঃখে এখন আর কেউ পাশে এসে দাঁড়ায় না। এখানে এখন এক একটি মুসলিম পরিবার একাকী, নিঃসঙ্গ, অনাহুতের মতো বসবাস করে।
নয়াদিল্লির অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ আলী খান মাহমুদাবাদ বলেন, ভারত এখন এমন এক দেশে পরিণত হয়েছে যেখানে মুসলমানরা মূলত প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। কারণ তাদেরকে সক্রিয়ভাবেই বাদ দেওয়া হয়েছে।
সালাম-উজমার বড় মেয়ে মরিয়ম খুব ভালো অ্যাথলেট ছিল। কিন্তু স্কুলে পড়ার সময় মুসলিম হিসেবে সে এতোটাই নিগৃহীত হয়েছে যে, দীর্ঘদিন মানসিক কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন পড়েছিল। অনেকদিন সে স্কুলেও যায়নি। এখন স্নাতক শিক্ষার্থী। এই মানসিক আঘাত মরিয়ম কাটিয়ে উঠতে পরেছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি চান না দিল্লির এই বাড়িতে থাকতে। তিনি চান দিল্লির কাছাকাছি উত্তর প্রদেশের নয়দার মুসলিম পাড়ায় গিয়ে থাকতে। যদিও তার বাবা-মা তাতে রাজি নন। বরং তারা চান, তাদের সন্তান বিদেশে পাড়ি জমাক।
কারণ হিসেবে সালাম বলেন, এখানে মুসলিমদের কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। রিয়েল এস্টেট এজেন্টরা সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, তারা হিন্দু না মুসলিম। কী হবে এদেশে থেকে যেখানে মুসলিমরা অস্তিত্বের সংকট নিয়ে বেড়ে উঠছে, প্রশ্ন তার।
সহসাই এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন না সালাম। বরং আবার মোদি ক্ষমতায় এলে আরও কোনঠাসা হয়ে পড়বে মুসলিমরা।
মাহমুদাবাদ আরও বলেন, জনপ্রতিনিধি ছাড়া আপনি রাষ্ট্রের কাছে প্রয়োজনীয়তার কথা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি বা অন্যান্য মৌলিক অবকাঠামোর বিষয়গুলো কীভাবে তুলে ধরবেন? মুসলিমদের হয়ে কথা বলার কে আছে এখানে?
আশির দশকের মাঝামাঝিতে ভারতের জনসংখ্যার ১১ শতাংশ ছিল মুসলিম। তখন পার্লামেন্টে তাদের আসন ছিল ৯ শতাংশ। এখন মুসলমান জনসংখ্যার হার বেড়েছে। কিন্তু পার্লামেন্টে তাদের আসন কমেছে। এখন মাত্র ৫ শতাংশ মুসলিম জনপ্রতিনিধি রয়েছেন পার্লামেন্টে।
ছয় বছর আগে, আগ্রার এক নামকরা স্কুল থেকে মুখ ভার করে বাড়ি ফিরেছিলেন এক মুসলিম ছাত্র। ৯ বছর বয়সী ছাত্রটি বাড়ি ফিরে তার মাকে বলেছিল, সে আর স্কুলে যাবে না।
ছাত্রের মা রীমা আহমেদ একজন লেখক ও প্রতিষ্ঠিত পরামর্শক। তিনি জানান, ছেলের অভিযোগ, সহপাঠীরা তাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। কিন্তু কী সেই বিদ্রুপ?
ছেলে জানায়, সহপাঠীরা প্রায়ই আমাকে বলে, ‘ও একটা পাকিস্তানি সন্ত্রাসী। ওকে মেরে ফেল’! কেউ কেউ ‘নর্দমার কিট’ বলেও ডাকে। এবং শিক্ষকরা এসব ঘটনা দেখেও না দেখার ভান করেন।
ওই স্কুলে আর যেতে হয়নি রীমা আহমেদের ছেলেকে। তিনি আর ছেলেকে ওই স্কুলে পড়াননি। বরং বর্তমানে ১৬ বছর বয়সী ছাত্রটি বাড়িতে বসেই মায়ের তত্ত্বাবধানে পড়ালেখা করে।
শুধু আগ্রাই নয়, বাকী ভারতেও এখন একই অবস্থা, আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন রীমা আহমেদ। অথচ একটা সময় ছিল যখন কে হিন্দু, কে মুসলিম আর কে শিখ; তা কোনও পরিচয় ছিল না। সবাই মিলে মন্দির চত্বরেই খেলাধূলা চলত।
মাহমুদাবাদ আরও বলেন, ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা নতুন নয়। তবে মোদির অধীনে তা আরও খারাপ হয়েছে। কারণ মোদির দল বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে সমর্থন করে। ক্ষমতাসীন দলই যদি একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক মনে করে, তাহলে সেখানে সেই জনগোষ্ঠীর বসবাস করাটা আরও কঠিন হয়েও ওঠে।
মুসলিম ছাড়াও শিখ, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মানুষও ভারতে সংখ্যালঘু। কিন্তু তাদের তুলনায় মুসলিমদের প্রতিই বিজেপির ক্ষোভটা যেন বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক মুসলমান বিশ্বাস করেন, প্রচারের কৌশল হিসেবে হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে প্রকট করছেন মোদি।
মোদির রাজ্য গুজরাটের ৬৪ বছর বয়সী এক মুসলিম ভোটার মেহমুদ ভাই খাত্রী বলেন, বিজেপি হিন্দু-মুসলিম ইস্যুকে জিইয়ে রেখেছে। ফলে তারা পরষ্পরের শত্রুই রয়ে গেছে। মুসলিমদের হয়ে কেউ কথা বললে তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। তার বাড়ি বুলডেজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তাহলে কথা বলবে কে?
ভারতের ২৮টি রাজ্যের একটিতেও একজনও মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী নেই। ১৯টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির। এমনকি যে উত্তর প্রদেশে সবচেয়ে বেশি মুসলমানদের বসবাস, জনসংখ্যার ১৬ শতাংশই মুসলিম, সেখানে মুসলিম বিধায়কের হার মাত্র ৭। পুরো ভারতের ২৮ রাজ্যে চার হাজারের বেশি বিধায়ক। তাদের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ মুসলিম।
বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপি যত শক্তিশালী হয়ে উঠছে, বিরোধী দলগুলোও হিন্দু ভোটারদের বিচ্ছিন্ন করার ভয়ে মুসলিম প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
দিল্লির এক মুসলিম ক্যাব চালকের প্রশ্ন, পার্লামেন্টে যদি একজনও মুসলমান না থাকে তাহলে আওয়াজ তুলবে কে?
যদিও বিজেপি মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু ২০১৪ সালে যখন মোদি প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন, তখন বিদায়ী পার্লামেন্টে ৩০ জন মুসলিম বিধায়ক ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন বিজেপির। আর এখন লোকসভার ৫৪৩ আসনের ২৫টিতে মুসলিম বিধায়ক থাকলেও, একটিও বিজেপির নয়। অবশ্য বিজেপির দাবি, ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে ১৩ জন মুসলিমকে প্রার্থী করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের কেউ জয়ী হননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোদি নিজেই যখন মুসলিমদের আক্রমণ করে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদেরকে অনুপ্রবেশকারী বলছেন, তখন কেন কেউ মুসলিম প্রার্থীকে ভোট দিতে যাবে?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাহমুদাবাদ আরও বলেন, ভারত জাতিগতভাবে একটি বহুমাত্রিক দেশ। বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই এই সমাজের ঐতিহ্য। ইসলামকে বাদ দিয়ে এখানকার সমাজের ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করা সম্ভব নয়।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, এপি।