ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাতে অনুপস্থিত লেবাননের সরকার

ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে চলমান সংঘাতের সময়ে যখন দেশটি কেবল নাগরিকদের দৃঢ়তায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে, তখন লেবাননের সরকারের কার্যত কোনও অস্তিত্ব নেই। অর্থনৈতিক পতন, রাজনৈতিক স্থবিরতা ও অন্যান্য সংকটের মধ্যে আগে থেকেই নুইয়ে পড়া লেবানন বর্তমানে নতুন করে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাতের মধ্যে পড়েছে। দেশটির সামর্থ্য ক্রমেই ভেঙে পড়ছে, আর সরকারের ভূমিকা যেন কেবল নামমাত্র রয়ে গেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর জানিয়েছে।

অর্থনৈতিক সংকটে দেশটির অনেক মানুষই বিদেশে গিয়ে জীবনযাপন করার সুযোগ হারিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে তাদের জমানো টাকা আটকে আছে, অনেকেই সেই টাকা পাওয়ার জন্য ব্যাংক ডাকাতি করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া হাজার হাজার ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা সহকারী, পাশাপাশি তরুণ পেশাজীবী এবং উদ্যোক্তারা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে, শিক্ষকরা মাসের পর মাস বেতন পান না, আর ছাত্রছাত্রীরা বই কেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

লেবাননের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বোঝা কঠিন নয়। অনেকের মতে, এই বিপর্যয় শুরু হয় ২০১৯ সালে যখন দেশটির অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে এবং শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সেই সময়ের গণবিক্ষোভও ব্যর্থ হয়েছে লেবাননের রাজনৈতিক শ্রেণিকে সরাতে।

এরপর ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি আরও অর্থনীতিকে দুর্বল করে তোলে। একই বছরের আগস্টে বৈরুত বন্দরে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ পুরো রাজধানীর বিশাল এলাকাকে ধ্বংস করে দেয়। তবে, তারও আগেই সংকট শুরু হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন—১৯৯০ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের পর যে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার কথা ছিল, তা কখনও আসেনি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, লেবাননের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য দেশটির নেতৃত্ব সরাসরি দায়ী। এক পর্যবেক্ষক বলেন, হিজবুল্লাহ যেমন লেবাননের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে, তেমনি সরকারের ব্যর্থতা পুরো দেশটিকে অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে গেছে।

নিহত হিজবুল্লাহ প্রধানের স্মরণসভা। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস

এ পরিস্থিতিতে যখন ইসরায়েলের হামলা শুরু হয়েছে, তখন লেবানন পুরোপুরি অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছে। দক্ষিণ লেবানন থেকে অন্তত ১ লাখ ১৮ হাজার নাগরিক দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, তাদের আশ্রয় নেওয়ার সরকারি ব্যবস্থাও যথেষ্ট নয়। লেবাননের সরকার শত শত সরকারি ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করলেও, সেখানে প্রয়োজনীয় খাদ্য, তোষক, বা অন্যান্য সরবরাহের কোনও ব্যবস্থা ছিল না।

লেবাননের সেনাবাহিনীও কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে। পার্লামেন্টের একজন স্বতন্ত্র সদস্য মার্ক দাও জানান, সরকার যা করতে পারছে না, তা হিজবুল্লাহ একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সরকার কার্যত আর কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তারা হিজবুল্লাহর সিদ্ধান্তে বন্দি।

লেবাননের বর্তমান রাজনৈতিক স্থবিরতা এবং হিজবুল্লাহর বাধা সৃষ্টির কারণে দেশটি দুই বছর ধরে প্রেসিডেন্টবিহীন এবং কেবল একটি অস্থায়ী সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। দেশটি বিদ্যুৎ সরবরাহও প্রায় বন্ধ করে রেখেছে। ফলে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে জেনারেটরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

এই সংকটের মধ্যে, ব্যক্তিগত উদ্যোগ, দাতা এবং নাগরিক সহায়তা গোষ্ঠীগুলো এগিয়ে এসেছে। বৈরুতে অনেক স্থানীয় স্কুল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান আশ্রয় প্রদান করছে। তবে এই ধরনের প্রচেষ্টাগুলো সরকারকে ছাড়িয়ে চলছে, কারণ সরকার প্রায় কোনও ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

মারাত্মক বিস্ফোরণের পরে যেমন নাগরিকরা নিজেরাই এগিয়ে এসে শহর পরিষ্কার করেছিলেন, তেমনি এখনও তারাই বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার, পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ পৌঁছে দিচ্ছে।

লেবাননের একটি স্থানীয় ত্রাণ সংস্থার প্রধান বলেন, এই দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই একের পর এক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। সরকার নেই বললেই চলে। সাধারণ মানুষকেই নিজেদের বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হচ্ছে।

লেবাননের নাগরিকদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি যেন আবারও আগের মতো হয়ে গেছে। যুদ্ধ আর সংকটের মধ্যে দিয়ে চলতে গিয়ে তারা এক ধরনের মরিয়া অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।