ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে নীরব সিরীয় সরকার

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই ইরান ও ইসরায়েল প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু এই দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় যখন প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো মুখ খুলছে, তখন সিরিয়া অবস্থান নিয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। রাজধানী দামেস্কে বসে রাতে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্রের আলোর ঝলকানি দেখছেন সাধারণ মানুষ। সরকার যুদ্ধ নিয়ে কোনও মন্তব্য করছে না। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানিয়েছে।

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের এক সার্জন মোহাম্মদ খায়ের আল-জিরুদি বলেন, রাতে আমার বারান্দা থেকে ইসরায়েলের দিকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষণ করি। মানুষ খুন আর ধ্বংস নিয়ে ক্লান্ত। তাই এখন আমরা শুধু দর্শক, কারও ওপর উল্লাস করছি না।

২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ইরান। সামরিক উপদেষ্টা, আঞ্চলিক মিত্র গোষ্ঠী এবং অস্ত্র দিয়ে আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখে তেহরান। অন্যদিকে, ১৯৬৭ সালে সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল এবং সেখানে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ মিশনের আশেপাশে এখনও অবস্থান করছে ইসরায়েলি সেনারা।

এই দুই শক্তিশালী দেশ সিরিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখলেও বর্তমানে দামেস্ক নতুন এক পরিমিত অবস্থান নিচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শেষে পুনর্গঠনের পথে থাকা দেশটি এবার নিজেকে যেকোনও আঞ্চলিক সংঘাত থেকে দূরে রাখতে চায়।

দামেস্কের জনপ্রিয় রাওদা ক্যাফেতে স্ত্রীকে নিয়ে বসে থাকা অভিনেতা আহমাদ মালাস বলেন, আমি চাই ইরান ও ইসরায়েল—এই দুই স্বৈরাচারী ব্যবস্থার থেকেই মুক্তি। কিন্তু একই সঙ্গে ইরানি ও ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি আমাদের আবেগ রয়েছে, তাদের সংগ্রাম অনেক আগে থেকেই আমাদের সংগ্রাম।

২০১১ সালের বিক্ষোভ দমনের সময় ইরানের সামরিক হস্তক্ষেপ এবং বিপুল সমর্থন সিরিয়ার বহু নাগরিকের মধ্যে তেহরানের প্রতি ক্ষোভ তৈরি করেছে। আসাদ পতনের পর হাজারো ইরানি সিরিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়, দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে লুটপাট ও ভাঙচুর হয়। এখনও দূতাবাসের দেয়ালে লেখা রয়েছে—‘ইরান নিপাত যাক’, ‘ফ্রি ইরান’।

বর্তমানে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারা বারবার ইরানের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনুপ্রবেশ না করার শর্তেই তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন সম্ভব।

জবাবে ইরান জানায়, তারা সিরিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে তাড়াহুড়ো করছে না।

ইসরায়েল এর মধ্যেই বহুবার সিরিয়ার ভেতর বিমান হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্য ছিল, নতুন সরকার বা ইসলামপন্থি গোষ্ঠীর হাতে উন্নত অস্ত্র যেন না পৌঁছায়। এ ছাড়া গোলান মালভূমির কাছে সংঘর্ষপূর্ব অঞ্চল থেকেও প্রায়ই অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা, যাকে দামেস্ক অবৈধ বলেছে।

এতসব ঘটনার মাঝেও সিরিয়ার সরকার এই যুদ্ধ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়াকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আহ্বান জানিয়েছে। দামেস্ক এরইমধ্যে জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনে পরোক্ষ আলোচনা করছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক বাসসাম আল-সুলেইমান বলেন, সিরিয়া নিরপেক্ষতা বজায় রাখছে। যুদ্ধের আলোচনায় সম্পৃক্ত না হওয়ারই চেষ্টা করছে, কারণ আমাদের এখন একমাত্র লড়াই অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের।

তিনি বলেন, ইসরায়েল ও ইরান উভয়ই বিপদের উৎস, কিন্তু এ যুদ্ধে আমাদের কোনও লাভ নেই।

এই নিরপেক্ষ অবস্থানের পেছনে কৌশলগত দায় আছে বলে মত বিশ্লেষকদের। কারণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে এখন সিরিয়ার লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উত্তরণ।

তবে আকাশে উড়ন্ত ক্ষেপণাস্ত্রের শিকার হয়ে এখনও সিরিয়ার অন্তত একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন।

দামেস্কের একটি ছাদের ওপর নাইটক্লাবে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটাতে আসা ২৭ বছর বয়সী এক চিকিৎসক সারাহ বলেন, আমরা যুদ্ধ ভুলে কিছু সময় কাটাতে এখানে আসি। তবু মনে হয়, যুদ্ধের প্রভাব কোনও না কোনোভাবে আমাদের ছুঁয়ে যাবেই।