ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত ২০ বছরের কম বয়সীরা

চার বছরের শিশু আফরা রহমান। গত সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছে। তবে আরেক শিশু আট মাস বয়সী মিনা খাতুন আফরার মতো ভাগ্যবান ছিল না। দাদা শাহজাহান মিঞা হাসপাতালে এনে ভর্তি করানোর আগেই মারা যায় মিনা খাতুন।

গত ৫ আগস্ট এই হাসপাতালেই ভর্তি করানো হয় তিন মাস ২৭ দিন বয়সী আহমদকে। প্রথমে সাধারণ বেড, পরে আইসিইউ; সর্বশেষ লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় ২২ আগস্ট রাতে আহমদ মারা যায়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত একদিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২০ বছরের কম বয়সীরা হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ভর্তি হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৭৫ জন। এর মধ্যে শূন্য থেকে এক বছর বয়সী রোগী ভর্তি হয়েছে এক দশমিক চার শতাংশ, শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ২৬ দশমিক এক শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ২২ দশমিক তিন শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ১৯ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ১০ দশমিক চার শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ১২ দশমিক তিন শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ভর্তি হয়েছে পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ আর ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের হাসপাতালে ভর্তির হার তিন দশমিক তিন শতাংশ।

একদিনে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে ঢাকার ২২০ জন ও ঢাকার বাইরের ৫৫ জন। এ ছাড়া চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ৯১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং ছাড়া পেয়েছেন ১০ হাজার ৮০৬ জন।

সোমবার (৬ আগস্ট) সন্ধ্যায় রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কথা হয় ডা. মোহাম্মদ মনির হোসেনের সঙ্গে, যিনি ঢাকা শিশু হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক।

তিনি বলেন, ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পিআইসিইউতে রয়েছে মোট ১৭টি বেড। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই (দু’একজন বাদ দিলে সবই) ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু। এসব রোগীদের মধ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে কম বয়সী ছিল তিন বছরের একটি শিশু। আর সবচেয়ে বেশি বয়সী রোগীর বয়স ছিল ১৭ বছর।

শিশুদের সংক্রমণের হার এবার বেশি কিনা- এমন প্রশ্নে ডা. মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, এটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দেশে এতদিন ডেঙ্গুর যে গাইডলাইন মানা হচ্ছে সেখানে প্রথম চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে জ্বর কমে যায়। কিন্তু এখন দ্রুততার সঙ্গে ‘মাল্টি অর্গান ফেইলিউরে’ চলে যাচ্ছে।

নিজের ৮ বছর বয়সী এক রোগীর অবস্থার কথা জানিয়ে তিনি বলেন- ছেলেটার ব্রেইন, লিভার, হার্ট ও কিডনি ইনভল্ব হলো। পাঁচ দিনের ভেতরে একটি শিশুর যখন চারটি অর্গান একসঙ্গে কাজ করা থামিয়ে দেয় বা খারাপ হতে থাকে, তখন তার অবস্থা কোথায় যায় বা যেতে পারে- প্রশ্ন করেন ডা. মনির।

তিনি বলেন, অভিভাবকরা জ্বর হলে বাসাতেই রেখে দিচ্ছে। অথচ এবার জ্বর হলে প্রথম দিনে না হলেও দ্বিতীয় দিনে অবশ্যই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। এ ছাড়া চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে কোনও দ্বিধা বা সময়ক্ষেপণ না করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।

রাজধানীর বেসরকারি সেন্ট্রাল হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি আছেন তার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ডেঙ্গু রোগী।  

শিশু বিভাগের অধ্যাপক ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাঈদা আনোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভর্তি থাকা শিশুর মধ্যে অর্ধেক শিশুই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এ ছাড়াও পুরো হাসপাতালেই প্রায় অর্ধেক রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

৮ মাস বয়সী শিশুও এখন তার অধীনে ভর্তি রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কিশোর-কিশোরীদের আক্রান্তের হারও এবার অনেক।

অধ্যাপক ডা. সাঈদা আনোয়ার বলেন, এবার বড় সমস্যা হচ্ছে রোগী খুব দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসা করার মতো সময়ও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অবহেলা করার কোনও সুযোগ নেই। জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে সেটা ফোনে নয়, সরাসরি; যেন চিকিৎসক রোগীকে দেখতে পারেন। 

এদিকে অধিদফতর জানাচ্ছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৫২ জন। আর সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে এক হাজার ২৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এরমধ্যে ঢাকাতেই আছেন এক হাজার ৭৪ জন, বাকি ১৫৯ জন অন্য বিভাগে। 

এ ছাড়া চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গুতে শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৭৩৫ জন আর মারা গেছেন ছয়জন। গেল আগস্টে শনাক্ত হয়েছেন এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সাত হাজার ৬৯৮ জন আর মারা গেছেন ৩৪ জন। তার আগের মাস জুলাই মাসে দুই হাজার ২৮৯ জন শনাক্ত হন, আর মারা যান ১২ জন। তবে এর আগ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কোনও মৃত্যু হয়নি বলে জানিয়েছে অধিদফতর।