বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, জরায়ুমুখ ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচআর-এইচপিভি) সংক্রমণের হার এখনও তুলনামূলক কম থাকলেও অঞ্চলভেদে এর পার্থক্য সুস্পষ্ট। এর হার সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৫৬ থেকে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে পরিচালিত ৩ হাজার ৮৫৬ জন নারীর ওপর একটি বিশ্লেষণাত্মক গবেষণায় দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে এইচআর-এইচপিভি সংক্রমণের হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, সংখ্যায় যা ১৩৮ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল সিলেটে (৬ দশমিক ৪ শতাংশ) এবং সর্বনিম্ন রাজশাহীতে (১ দশমিক ৭ শতাংশ)। সিলেটের গ্রামীণ অঞ্চলে সংক্রমণ ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ, যা শহরাঞ্চলের তুলনায় বেশি। গবেষণায় ৩৫-৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণের হার সর্বাধিক পাওয়া যায়।
রবিবার (২৫ মে) বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে ইলেকট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচির উদ্যোগে আয়োজিত ওই প্রকল্পের তথ্য ও বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে এসব তথ্য জানানো হয়। ‘ইলেক্ট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং’ শীর্ষক কর্মসূচির ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন প্রকল্প পরিচালক ও বিএমইউ‘র গাইনি অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা। বিএমইউ’র অধ্যাপক ডা. শিরিন আক্তার বেগমের নেতৃত্বে শহর বনাম গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে এই জরিপ পরিচালিত হয়।
ফলাফল প্রকাশসহ প্রকল্পের বিস্তার, অগ্রগতি, সফলতা, সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতা জনসম্মুখে তুলে ধরা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়। এই গবেষণাগুলোর ফলাফল বাংলাদেশের জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের কার্যকর উন্নয়ন এবং নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা সরকার, স্বাস্থ্য পেশাজীবী ও স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে ভবিষ্যৎ স্ক্রিনিং কার্যক্রমকে আরও জোরদার করার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে উপকূলীয় এবং উচ্চ-প্রকোপযুক্ত অঞ্চলে (সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম) এইচআর-এইচপিভি স্ক্রিনিং চালু করা, গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে সমান গুরুত্ব দিয়ে স্ক্রিনিং সম্প্রসারণ, ৩৫-৪৪ বছর বয়সীদের অগ্রাধিকার, জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ই-স্বাস্থ্য প্ল্যাটফর্মের উন্নয়ন, ভায়া+ এইচপিভি’র সম্মিলিত পদ্ধতির মাধ্যমে ট্রাইএজ এবং ফলোআপ নিশ্চিতকরণ, ল্যাবরেটরি ও হিস্টোপ্যাথলজি রিপোর্টিংকে ই-এইচআইএসের সঙ্গে যুক্ত করা—ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়। অনুষ্ঠানে সেরা কমিউনিটি ক্লিনিক, সেরা ভায়া ও সিবিই কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৪৬ জনকে পুরস্কৃত করা হয়।
বিএমইউ’র সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর-ই-ফেরদৌসের নেতৃত্বে উপকূলীয় অঞ্চলে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের তিনটি জেলায় (ঝালকাঠি, কক্সবাজার, বাগেরহাট) বিবাহিত ৯০০ জন মহিলার মধ্যে এইচআর-এইচপিভি সংক্রমণের হার ছিল ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, সংখ্যায় যা ২৬ জন। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ পাওয়া গেছে ঝালকাঠিতে (৩ শতাংশ)। সবচেয়ে বেশি পাওয়া জিনোটাইপ ছিল এইচপিভি ধরন ১৬ (৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ)। গবেষণাটি এই অঞ্চলে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে জিনোটাইপিংভিত্তিক স্ক্রিনিং প্রবর্তনের সুপারিশ করে।
মুগদা মা ও শিশু হাসপাতালের ডা. জাকান্ত ফাইকার স্ক্রিনিং পদ্ধতির তুলনা বিষয়ক গবেষণায় ৪ হাজার ৭৯২ জন নারীকে দুটি গ্রুপে ভাগ করে ভায়া + এইচপিভি এবং শুধু এইচপিভি স্ক্রিনিংয়ের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হয়। ভায়া + এইচপিভি পদ্ধতিতে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ পজিটিভ পাওয়া গেলেও শুধু এইচপিভি’তে এই হার ছিল ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। একত্রিত পদ্ধতিতে রোগ শনাক্তকরণ ও ফলোআপের হার বেশি ছিল, যা স্ক্রিনিং কার্যক্রমের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের দুটি উপজেলায় জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি পরীক্ষা বিষয়ক একটি পাইলট গবেষণা পরিচালনা করেন ডা. আসমা আক্তার সোনিয়া। বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ে জিনোটাইপসহ উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি পরীক্ষার ভূমিকা চিহ্নিত করাই এর উদ্দেশ্য। প্রতিটি গবেষণা এলাকা থেকে ৩০-৬০ বছর বয়সী ১০ হাজার নারীদের নিয়ে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণার ফলাফলে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, সংখ্যায় ৩১৮ জন নারীর এইচআর-এইচপিভি সংক্রমণ রয়েছে। সব নারীদের মধ্যে, ১ শতাংশ, সংখ্যায় ৯৭ জন নারীর এইচপিভি ধরন ১৬ এবং ০ দশমিক ২ শতাংশ, সংখ্যায় ২০ জন নারীর এইচপিভি ধরন ১৮ ছিল। এই গবেষণায় এইচআর-এইচপিভির প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে কম (৩ দশমিক ২ শতাংশ)। ভায়া এর তুলনায় এইচআর-এইচপিভি পরীক্ষা উচ্চ সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে বলে প্রমাণিত।
জাতীয় পর্যায়ে স্ক্রিনিং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিএমইউ এর অধ্যাপক আশরাফুন্নেসার নেতৃত্বে রাজশাহী বিভাগে ডিএইচআইএস২ ভিত্তিক একটি ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থার ই-এইচআইএস এর মাধ্যমে স্ক্রিনিং কার্যক্রম পরিচালনা ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত, দেশের ১৪ হাজার ২১৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে স্ক্রিনিং, কলপোস্কোপি এবং ট্র্যাকিং-এর মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। তবে, দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে। ডা. আসমা আক্তার সোনিয়া আরও জানান, জরায়ু ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য ৬০ লাখ ৯৩ হাজার ২২৪ জন নারীর ভায়া পরীক্ষা করে ২ লাখ ৫ হাজার ৩৫৮ জনের পজিটিভ পাওয়া যায়, শতকরা হিসাবে এ হার ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশে লক্ষ্যমাত্রার ২১ শতাংশ মহিলাকে স্ক্রিনিং কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
দুই পর্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে গবেষণাগুলোর ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। প্রথম পর্বে সভাপতিত্ব করেন বিএমইউর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। দ্বিতীয় পর্বে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএমইউর ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএমআরসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. নূরে আলম সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএমইউ’র প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ। বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রতিরোধ কার্যক্রম বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন প্রকল্প পরিচালক (ইপিসিবিসিএসপি) অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, ‘মানুষের স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে ও চিকিৎসাসেবাকে মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে রাখতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ক্যানসারের পূর্বাবস্থা নির্ণয় করতে পারলে অনেক মায়ের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে। ইলেকট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচির কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, ‘অপ্রতুল বাজেট ও প্রয়োজনীয় তুলনায় স্বল্প বাজেট দিয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে। ইলেকট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচির আজকের অনুষ্ঠানটিও অসাধারণ। যেখানে স্বাস্থ্যখাতের তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারা রয়েছেন। কমিউনিটি পর্যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অপূর্ব মেলবন্ধন আজকের আয়োজন। জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ, চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণ ও নারী স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে ইনস্টিটিউটে উন্নীত করা হবে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ ব্লকের ষষ্ঠ, দশম ও ১১ তলা নিয়ে স্তন ক্যানসার ও জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্ণয়ে স্ক্রিনিং কার্যক্রম, চিকিৎসাসেবাসহ এ ধরনের রোগীদের সামগ্রিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি আলাদা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হবে।