প্রাণ উজাড় করা ম্যাচগুলোর অবদান কী কম! রয়ে গেল আক্ষেপ

পৃথিবীর বুকে এমন নজির আর আছে কি? গবেষণার বিষয় বটে। হয়তো দ্বিতীয়টি মিলবে না। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মুক্ত পতাকার জন্য খেলা হলো একের পর এক ফুটবল ম্যাচ! পা টনটন করছে, তাতে কী! খেলা হলে লোকে জানবে একটি মুক্তিসংগ্রামের কথা। তৈরি হবে জনমত। আর তাই ব্যতিক্রমী যুদ্ধের অনন্য উদাহরণ হিসেবে আছে ঘটনাটি।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সরাসরি অস্ত্র না ধরে যুদ্ধ করার অন্যরকম নজির আছে অনেক। পাশের দেশ ভারতে গিয়ে একের পর এক প্রদশর্নী ম্যাচ খেলাটা বোধহয় ব্যতিক্রমের ভেতরেও ব্যতিক্রম। নিজেকে উজাড় করে মাঠে বলের কারিকুরি দেখিয়ে বাইরের বিশ্বের কাছে তাঁরা জানিয়েছেন একটি দেশের মুক্তিসংগ্রামের কথা। কম আলোড়ন তোলেনি ওই ঘটনা। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পেছনে ওই দলের অবদানকে ছোট করে দেখার জো নেই মোটেও। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পালিত হতে চললেও এখনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি ‘স্বাধীন বাংলা দল’।

স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে গিয়েছিল ৩৬ জনের ফুটবল দল। অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। দেশের ফুটবল কিংবদন্তী কাজী সালাউদ্দিনসহ ছিলেন আরও অনেকে। নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে খেলে গেছেন একের পর এক ম্যাচ।

১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই ভারতের নদীয়ার কৃষ্ণনগরে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন পিন্টু-সালাউদ্দিনরা। সেই ম্যাচের পরতে পরতে ছিল উত্তেজনা, শিহরণ। তখনও বাংলাদেশ স্বীকৃতি পায়নি। তবে ফুটবলারদের দাবি মেনে ম্যাচের আগে বাংলাদেশের পতাকা উঠেছে মাঠে। বেজেছে ‘আমার সোনার বাংলা’।

তারপর ভারতের বিভিন্ন শহরে আরও ১৫টি ম্যাচ খেলেছিলেন পিন্টু-সালাউদ্দিনরা। তাদের এই অন্যযুদ্ধ সাড়া ফেলেছিল পুরো ভারতজুড়ে। মুম্বাইয়ে (তখনকার বম্বে) একটি ম্যাচে স্বাধীন বাংলা দলের বিপক্ষে খেলেছিলেন ভারতের ক্রিকেট তারকা মনসুর আলী খান পতৌদি। সেই ম্যাচ গ্যালারি থেকে দেখেছিলেন বলিউড কিংবদন্তি দিলীপ কুমার ও অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর। তারাও একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন ফুটবলারদের ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগে।

ফুটবল দলটির এই কীর্তি সবার বেশ ভালোভাবেই জানা। কিন্তু স্বাধীন বাংলা দলের অনেক খেলোয়াড়ই স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরলোকে। ৩৬ জনের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন ২৪ জন। অবশ্য অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ও কাজী সালাউদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। কিন্ত দলটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পাওয়াতে সবাই বেশ ব্যথিত।

জাকারিয়া পিন্টু আগেই দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি অনেকবার এই দলকে স্বাধীনতা বা জাতীয় পুরস্কার দেওয়ার অনুরোধ করেছি সরকারকে। বুঝতে পারছি না আমাদের দলটাকে কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে অবশ্যই পুরস্কার দেওয়া উচিত।’

বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক ও আবাহনী লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুণুর রশীদ অবশ্য অন্য কারণ দেখছেন। বিভিন্ন পুরস্কার দেওয়ার কমিটিতে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে এই সংগঠক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘হয়তো স্বীকৃতির জন্য সঠিকভাবে আবেদন করা হয়নি। স্বাধীন বাংলা দলের কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। দলটির অনেকেই আছেন গরীব অসহায়। তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য করা হচ্ছে। আমার মনে হয় সেভাবে স্বীকৃতির জন্য উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।’

তিনি আরও বলেছেন,‘আমি একটু উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো এই স্বাধীন বাংলা দলের কেউ নই। সে জন্য কাজ হয়নি। অন্য কারণও থাকতে পারে। তবে আমি মনে করি সবাই মিলে ঠিকমতো উদ্যোগ নেওয়া হলে স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব। এখনও সময় আছে।’

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন অবশ্য এ নিয়ে শুরুতে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। একপর্যায়ে কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমি যেহেতু স্বাধীন বাংলা দলে খেলেছি তাই কোনও মন্তব্য করতে চাই না। এই বিষয়ে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞেস করুন। আমি কেন চাইতে যাব। আমি তো যুদ্ধ করেছি। স্বীকৃতি চেয়ে নেব কেন?’

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল অবশ্য এই প্রসঙ্গে ব্যাখা দিয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের কাছে, ‘আমরা বিভিন্ন পদক দেই সংগঠক ও খেলোয়াড়কে। কোনও প্রতিষ্ঠানকে দেই না। স্বাধীন বাংলা দলের পক্ষে চাওয়ার দরকার ছিল। আবেদন থাকলে আমাদের সুবিধা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। রাষ্ট্র তো সবাইকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি। তারা (স্বাধীন বাংলা দল) এগিয়ে আসলে আমাদের সুবিধা হয়। আবেদন না করলে তো কেউ দেবে না।’

এরপর আশার কথা শোনালেন ক্রীড়া প্রশাসনের সর্বোচ্চ এই কর্তা- ‘সামনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার চালু করতে যাচ্ছি। স্বাধীন বাংলা দলের স্বীকৃতি নিয়ে চিন্তা করতে পারি। ভবিষ্যতে স্বাধীনতা ও একুশে পদক রাষ্ট্রীয়ভাবে আসতে পারে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কিনা চেষ্টা করবো।’