‘সেই রাতে কবরীর বাড়িতে গাড়িচালকদের নিয়ে তাস খেলছিল কেয়ারটেকার’

রাজধানীর গুলশানে প্রয়াত অভিনেত্রী-নির্মাতা ও সাবেক সংসদ সদস্য কবরীর বাড়িতে রহস্যজনক ঘটনার রাতে কেয়ারটেকার শহিদুল ইসলাম গাড়িচালকদের নিয়ে তাস খেলছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ এমনটাই জানতে পেরেছে। তবে এখনও আতঙ্কে আছেন কবরীর ছোট ছেলে শাকের ওসমান চিশতী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের ফ্ল্যাট দখলের জন্য পরিকল্পনা সাজিয়ে এসব চক্রান্ত করা হচ্ছে।’

গত ২৭ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন শাকের ওসমান চিশতী। তিনি দাবি করেন, বাড়িটিতে ডাকাত পড়েছে। খবরটি জেনে গুলশান থানা পুলিশের কয়েকটি টিম বাতি নেভানো ওই ভবন ঘেরাও করে। নিরাপত্তাকর্মীকে ডেকে তুলে বাতি জ্বালিয়ে তল্লাশি চালায় পুলিশ। পরে দোতলায় একটি ফ্ল্যাটে সেখানকার কেয়ারটেকার ফরিদ, বাড়ির কেয়ারটেকার শহিদুলসহ কয়েকজনকে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা।

কবরীর ছেলে বাংলা ট্রিবিউনকে সেই রাতের বর্ণনা দেন, ‘সিসি ক্যামেরায় দেখি নিচের সব বাতি নেভানো। দুটি মোবাইল ফোনের আলোতে কেউ সিঁড়িতে ও বেজমেন্টে হাঁটাহাঁটি করছে। মুহূর্তেই ইন্টারকমে ফোন দেই। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মী ফোন তোলেনি। এ কারণে আতঙ্কিত হয়ে যাই। পরে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেই। পুলিশ আসার পর নিচে নামি। তখন একটি বাতি জ্বালিয়েছে নিরাপত্তাকর্মী। পুলিশ ভেতরে এসে প্রথমে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সে জানায়, বাড়ির কেয়ারটেকার তাকে সব বাতি নিভিয়ে দিতে বলেছে। শহিদুলকে পুলিশ ফোন দিলে সে জানায়, নিজের বাসায় ঘুমাচ্ছে।’

সেই রাতে প্রথমে নিরাপত্তাকর্মীর কাছে পুলিশ জানতে চায় বাড়ির ভেতরে কেউ ঢুকেছে কিনা। তার উত্তর ছিল, দোতলায় একটি ফ্ল্যাটে ফরিদ নামে একজন কেয়ারটেকারসহ কয়েকজন আছে। ফ্ল্যাটের মালিক বা ভাড়াটিয়া কেউ থাকে না। তখন দোতলায় গিয়ে কলিংবেল চাপে পুলিশ। তবে সাড়া দিচ্ছিল না কেউ। পুলিশ দরজা ভেঙে ফেলবে জানাতেই খুলে দেন ফরিদ। দরজা খোলার পর পুলিশের চোখে পড়ে, বাড়ির কেয়ারটেকার শহিদুল ভেতরেই আছে। এরপরই পুলিশ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আজিজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে ঘটনার বিষয়ে বলেন, ‘৯৯৯ নম্বরে ডাকাতের খবর পাওয়ার পর আমরা বাড়িটি ঘেরাও করি। কিন্তু ভেতরে প্রবেশের পর ডাকাত পাইনি। পরে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। মূলত নিরাপত্তাকর্মী, বাড়ির কেয়ারটেকার, অন্যান্য ফ্ল্যাটের গাড়িচালকসহ কয়েকজন মিলে তাস খেলছিল। সিসি ক্যামেরায় যাতে ধরা না পড়ে সেজন্য বাতি নিভিয়ে রেখেছিল তারা। খেলা শেষে দুইজন রাতে বেরিয়ে চলে যায়। বাকি তিন-চারজন ছিল দোতলার একটি ফ্ল্যাটে। তাদের প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।’

এসআই আরও জানান, ২৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতের ওই ঘটনার পরদিন গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন শাকের ওসমান চিশতি। পুলিশ এখন সেটি তদন্ত করছে।

জিডিতে কবরীর ছেলের অভিযোগ, ‘গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে আমার বাসার সিঁড়িতে কিছু মানুষের আনাগোনার আওয়াজ পাই। সিসি ক্যামেরায় দেখি, গ্রাউন্ড ফ্লোরের সব বাতি নেভানো। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে ইন্টারকমে ফোন করি। কর্তব্যরত সিকিউরিটি গার্ড ফোন না ধরায় আমার সন্দেহ বাড়তে থাকে। ২০ মিনিট পর রাত ২টা ৫০ মিনিটে ক্যামেরায় দেখি তিন ব্যক্তি মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছেন, পরে একটি মোটরসাইকেলে চড়ে তারা চলে যায়।’

দোতলার ওই ফ্ল্যাটে কেয়ারটেকার ফরিদ নিয়মিত বহিরাগতদের নিয়ে আড্ডা দেয় দাবি করে শাকের ওসমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফরিদ এর আগেও খারাপ কাজ করে ধরা পড়েছিল। ওই ফ্ল্যাটে মাদকসেবনও করা হয়। ফ্ল্যাটটি খালি পেয়ে অপরাধীরা এখানে আশ্রয় নেয়। বাড়ির কেয়ারটেকার শহিদুলের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার সময় তারা সবাই মাদকাসক্ত ছিল। তাদের আটক করতে পুলিশকে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ তাদের কাউকে ধরে নেয়নি।’

বাড়িটির ফ্ল্যাট মালিক সমিতির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন শাকের ওসমান, ‘আমি সমিতির সভাপতি আসলাম সানি ও সাধারণ সম্পাদক শাহ জাকিরের কাছে ই-মেইলে বিষয়টি জানিয়েছি। তবে তিন দিন হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তারা কেউ আমাকে কোনও উত্তর দেননি।’

শাকের চিশতী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মা বেঁচে থাকা অবস্থায় এই বাড়ি নিয়ে একটি চক্র ষড়যন্ত্র করেছিল। মাকে তখন লাঞ্ছিত করা হয়, হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল তিনি গুলশান থানায় জিডি করেছিলেন।’

জিডিতে কবরী উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমার এই বাড়ি নিয়ে আদালতে মামলা আছে এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই বাড়িতে রঙ করা যাবে না। একপর্যায়ে বহিরাগতরা আমার ওপর চড়াও হন, আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন এবং মেরে ফেলার হুমকি দেন। এরপর অফিসের কর্মচারীদের খবর দিয়ে দ্রুত ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিই।’

গুলশান ২ নম্বরে পাঁচতলা ওই বাড়ির জমি কবরীর। অ্যাডভান্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে বাড়িটি গড়ে তোলেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটি তাদের ফ্ল্যাট বেচে দিয়েছে, কবরীও একটি ফ্ল্যাট রেখে বাকিগুলো বিক্রি করেছেন। বর্তমানে পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে তার ছোট ছেলে থাকেন। অন্য সন্তানরা প্রবাসী। তারা দেশে এলে এই ফ্ল্যাটেই ওঠেন। 

দেশের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ বছরের ১৭ এপ্রিল মারা যান। ব্যক্তিজীবনে তিনি প্রথমে বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। তার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে সফিউদ্দীন সরোয়ারের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন। ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী পাঁচ সন্তান রেখে গেছেন।