পেশাদার সন্ত্রাসী থেকে মহল্লার ছিঁচকে মাস্তানের কাছেও দেখা গেছে, অত্যাধুনিক বিদেশি অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। কম টাকায় এসব অস্ত্র জোগাড় করছেন সন্ত্রাসীরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটছে ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ। চীন ও ভারতের তৈরি এসব অস্ত্র ভারত সীমান্ত হয়ে বিভিন্ন উপায় বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
গত সপ্তাহে পুরান ঢাকা থেকে কয়েকটি বিদেশি অস্ত্রসহ কয়েকজনকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশে (ডিএমপি)। তাদের আটক-পরবর্তী এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক পরিচয়ে অস্ত্র কিনছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইউপি নির্বাচন চলছে। এসব অস্ত্র ইউপি নির্বাচনে ব্যবহার করা হতো। উদ্ধারকৃত অস্ত্র ভারত থেকে আনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগের নির্বাচনগুলোতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান চালানো হতো। বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জমা নেওয়ারও একটি নিয়ম চালু ছিল। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করা হতো। কিন্তু চলমান ইউপি নির্বাচনে ইসি সে নির্দেশনাও জারি করেনি। এ কারণে অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রেরও ব্যবহার বেড়েছে নির্বাচনি সহিংসতায়। তবে, ঘটনার পরও এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি।
রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জের মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে গত ৩০ মার্চ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় ৯ বছরের শিশু শুভ কাজী। এই ঘটনার পর থানা পুলিশ অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। তবে হামলায় নেতৃত্বদানকারী রানা মোল্লাকে সবাই দেখছে। তাকে আসামি করা হয়নি। আজও গ্রেফতার করা হয়নি শুভ হত্যাকারীদের। উদ্ধার হয়নি আগ্নেয়াস্ত্র।
গত শুক্রবার র্যাবের হাতে শেরেবাংলানগর থেকে গ্রেফতার হওয়া মাসুদ রানাও সীমান্ত থেকে অস্ত্র এনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে। শনিবার বিদেশি অস্ত্রসহ যাত্রাবাড়ী থেকে র্যাবের হাতে আটক হন বরিশালের সন্ত্রাসী মো. নাহিদ সেরনিয়াবাত (৩০) ও তার সহযোগী মো. জুবায়ের আলমকে (২৯) গ্রেফতার করেছে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন এবং ২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ২৫-৩০ হাজার টাকায় ভারতীয় ক্ষুদ্রাস্ত্র সীমান্ত থেকে কিনে ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। কক্সবাজারের মহেশখালীতে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে জলদস্যুসহ সন্ত্রাসীদের কাছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। এই চক্র জলদস্যু ছাড়াও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কাছেও অস্ত্র বিক্রি করছে। পেশাদার সন্ত্রাসীরা অস্ত্র কিনে ইউপি নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর জন্য ভাড়া দিচ্ছে। আবার পেশাদার ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজরা এই অস্ত্র কিনছে।
নির্বাচন ছাড়াও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েটি ঘটনা হলো, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কাফরুলে বিকাশ এজেন্টকে গুলি করে ১৩ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেন দুর্বৃত্তরা। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বংশালের সুরিটোলায় ইউসুফ নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে ৮০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন সন্ত্রাসীরা।
গত ৫ মার্চ আগারগাঁও-তালতলায় বিকাশ এজেন্ট সাইদুল ইসলামের পায়ে গুলি করে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে যান ছিনতাইকারীরা। একই দিন লালবাগের কাজী রিয়াজউদ্দিন রোডে ব্যবসায়ী তাসরিদের রিকশা থামিয়ে তার পায়ে গুলি করে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে যান দুর্বৃত্তরা।
গত ১৩ মার্চ রাজধানীর রামপুরার হাজিপাড়ায় স্যানিটারি সামগ্রী দোকানের ম্যানেজার ইসমাইল হোসেনকে গুলি করে হত্যার পর তিন লাখ টাকা ছিনিয়ে নেন সন্ত্রাসীরা।
৯ এপ্রিল শনিবার দুপুরে ডিবি পরিচয় দুই যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর এলাকা থেকে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছেন। তাদের কাছেও ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রায় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহৃত হলেও উদ্ধার হয় না এসব অস্ত্র।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের বর্থ্যতায় এসব ঘটছে। ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা এসব করছেন। তারা অন্যায় করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। তাই মানুষ মারা যাচ্ছেন। অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ক্রমাগত জালভোট বেড়েই চলছে। এসব কাঙ্ক্ষিত নয়। এসব প্রাণহানি বন্ধের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ডিএমপিতে পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলে। অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহে অনেককে আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা ইউপি নির্বাচনে অস্ত্র নিয়ে সহিংসতা চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।
এদিকে, এতসব অবৈধ অস্ত্র ও সহিংসতার মধ্যেই ২৩ এপ্রিল শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন। প্রথম দুই ধাপের সহিংসতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ জানিয়েছেন, এসব ঘটনার কারণ দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। এ জন্যই এসব সহিংসতা ঘটেছে।
/এমএনএইচ/