উত্তরসূরিতে দুই প্রজন্মের ‘একাল-সেকাল’

ষাটের দশকের অনন্ত যৌবনা নানান স্মৃতিকে ধারণ করে রাজধানীর বুকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে একটি বাড়ি। কেবল তাই নয়, সেই সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে এই প্রজন্মের উন্মেষ ঘটাতে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

 



বাড়িটির নাম ‘উত্তরসূরি।’ ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের ৭৬৫ নম্বর বাড়ি। বর্তমানে ‘উত্তরসূরি: নূরজাহান-সারওয়ার মুরশিদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’নাম ধারণ করেছে বাড়িটি। ‘একাল-সেকাল’ নামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে এখানে। শিক্ষাবিদ খান সারওয়ার মুরশিদের ৯৮তম জন্মদিন উপলক্ষে শুক্রবার (১ জুলাই) এটি উদ্বোধন করা হয়। পরদিন আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। আগামী ৮ জুলাই পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনীর দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকছে।

 



এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ, নাইব উদ্দিন আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, নাসির আলী মামুনের আলোকচিত্র। বেগার্টে সংরক্ষিত রয়েছে মনজুর আলম বেগের আর্কাইভ ও খান সারওয়ার মুরশিদ ও নূরজাহান মুরশিদের আর্কাইভ থেকে নথি, ব্যবহার্য বস্তু ও বইপত্র। অনন্য বেশ কিছু শিল্পকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। এর শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন- কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ, কাজী ইস্তেলা ইমাম, ফারজানা ইসলাম উর্মি, মুস্তাফা জামান, তেজস হালদার জস, হামিম কামাল, সায়কা শবনম চৌধুরী, সানজিদ মাহমুদ।



এতসব আয়োজনের গভীরে প্রথিত রয়েছে ‘সুষ্ঠু সমাজের অন্বেষায় আপন পরিবেশ’ ফিরিয়ে আনার এক অদম্য আকাঙ্খা। যার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন পঞ্চাশ-ষাট দশকের খ্যাতিমান রাজনীতিক, সমাজচিন্তক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও কিংবদন্তিতুল্য প্রতিভার অধিকারী খান সারওয়ার মুরশিদ। সেই সঙ্গে রয়েছেন তার সহধর্মিণী নূরজাহান মুরশিদ। তিনিও একই সময়ের বিখ্যাত রাজনীতিক, সমাজচিন্তক ও অসামান্য প্রতিভায় অনন্য ছিলেন। তারা বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশে পরস্পরে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছেন।

আয়োজকরা বলছেন, স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নকশায় ‘উত্তরসূরি’ বাড়িটি গড়ে উঠেছিল ষাটের দশকে। তখন এটি ঢাকার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। সেই সময়ের প্ররোধা ব্যক্তিত্বদের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা এবং তার সঙ্গে বর্তমান সময়ের চিন্তকদের ভালো কাজগুলোকে সামনে আনতে এই ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

উত্তরসূরি’র উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাংলা ট্রিবিউনের কাছে তুলে ধরেছেন প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ ও পরিচালক শিল্পী মোস্তফা জামান। তারা বলেন, 'খান সারওয়ার মুরশিদ যেমন অসাধারণ গুণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন, নূরজাহান মুরশিদও কোনও অংশে কম ছিলেন না। তারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক শূন্যতা পূরণ এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এটি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই আমরা। সেইসঙ্গে পঞ্চাশ-ষাটের দশকের প্রথম সারির অন্যান্য চিন্তকদের নিয়েও কাজ করতে চাই।'

উত্তরসূরির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে শারমিন মুরশিদ বলেন, 'স্মৃতিময় বাড়িটিতে শেষবারের মতো এবার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এতে একালকে সেকালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছি আমরা। উত্তরাধিকারের জটিলতার কারণে বাড়িটি আর রক্ষা করা যাচ্ছে না, শেষ পর্যন্ত ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে ১৬ জুলাই একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে এই স্থাপনার সঙ্গে একটি প্রজন্মের বিদায় নিয়ে আলোচনা হবে।'



'তবে বাড়িটি না থাকলেও উত্তরসূরি: নূরজাহান-সারওয়ার মুরশিদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাজ থেমে থাকবে না। বরং নতুন উদ্যমে আরও বিস্তৃত পরিসরে পরিচালিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে- পঞ্চাশ-ষাট দশকের বেশ কয়েকজন চিন্তকের ওপর আর্কাইভ করা এবং তাদের চিন্তা ও কাজ নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে নানা আয়োজন। এছাড়া লাইভ মেম্বার নেওয়ার কথাও আমাদের বিবেচনায় রয়েছে'- যোগ করেন তিনি।

উল্লেখ্য, ১ জুলাই সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘উত্তরসূরি’র প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, 'এখনকার তরুণ প্রজন্ম হতাশার মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। অথচ আমাদের সংস্কৃতিতে বিদ্রোহও ছিল। এখন সাংস্কৃতিক বিষণ্নতা কাটাতে আমাদের উত্তরসূরি বা প্রতিনিধিত্ব গড়ে তুলতে হবে। এই কাজটি উত্তরসূরি করতে পারে।'



উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খান সারওয়ার মুরশিদের জীবনের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মন্ময় জাফর। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, গবেষক মাহমুদ শাহ কোরেশী, অধ্যাপক ফখরুল আলম, দীপ্ত টিভির কর্ণধার জাহিদ হাসান, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ, শিল্পী রোকেয়া সুলতানা, ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান, আইভী জামান প্রমুখ।