কাজী শাহেদ আহমেদের নতুন উপন্যাস

আজ শনিবার (৭ নভেম্বর) বিশিষ্ট লেখক কাজী শাহেদ আহমেদের ৮০তম জন্মদিন। ১৯৪০ সালের এই দিনে তিনি যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিন উপলক্ষে বাংলা ট্রিবিউনের পাঠকদের জন্য জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের লেখা কাজী শাহেদ আহমেদের প্রকাশিতব্য উপন্যাস ‘কেউ কথা রাখল না’-এর মুখবন্ধ প্রকাশ করা হলো।nonameকাজী শাহেদ আহমেদের সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘কেউ কথা রাখল না’ এক হতদরিদ্র প্রতিবন্ধী এবং তার একমাত্র কন্যার জীবনের কাহিনি। এই দু’জনই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। তাদের জীবনযাপন নিয়ে এই উপন্যাস। সঙ্গে সঙ্গে এসেছে বেশ কয়েকজন কাছের ও দূরের মানুষ এবং সামাজিক চিত্র। একজন দরিদ্র মূক ও বধির মানুষ যে জীবনে দু-চারজন মানুষের সহানুভূতি ও সাহায্য ছাড়া আর কিছুই পায়নি। সে তার মা মরা মেয়েকে নিয়ে পরমানন্দে জীবনযাপন করছিল। তার এই জীবনের জন্য কোনো খেদ ছিল না। এই নির্লোভ মানুষটির পৃথিবী ছিল তার মেয়ে। তার মেয়েও জন্ম থেকেই পিতাকে অবলম্বন করেই আনন্দমুখর জীবন কাটাচ্ছিল। পিতাই ছিল তার বাবা ও মা। কিন্তু তাদের এই আনন্দময় জীবনের ছেদ পড়ল সমাজের এক মনুষ্য নামধারী ঘৃণ্য চরিত্রের কারণে। পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো অসহায় পিতাকে। মেয়েটির এখন অবলম্বন প্রতিবেশী এক হৃদয়বান শিক্ষক।

কাজী শাহেদ আহমেদের এই উপন্যাসে প্রতিবন্ধীদের প্রতি আমাদের সমাজের এক শ্রেণির ঘৃণ্য মনোবৃত্তের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সমাজের একটা বড় অংশের ধারণা, প্রতিবন্ধীদের জীবনধারার পরিণতি হলো ভিক্ষাবৃত্তি অথবা অপরাধ জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। কিন্তু এই উপন্যাসের নায়ক দৈহিকভাবে খর্বাকৃতির এবং বাক্ ও শ্রবণশক্তি রহিত হলেও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে সে যে একটা স্বাভাবিক জীবনযাপনের সংগ্রাম করছে, অপরাজিতভাবে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, সেই কারণে সে সমাজের এক শ্রেণির মানুষের চক্ষুশূল। সেই জন্যে সে যখন মেয়েকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে যায় সেখানে তাকে লাথি খেতে হয়। ঈদের জামাত থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। এমনকি প্রতিবেশীর মৃত্যু উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান খাবারের লাইন থেকে তাকে মিসকিনদের সারিতে ঠেলে দেয়া হয়, যার অর্থ: সে যতই স্কুলে ঝাড়-মোছার কাজ বা রেলস্টেশনে কুলিগিরি করুক, মেয়েকে স্কুলে পড়াক, তার আসল পরিচয় সে একজন মিসকিন, সমাজের একজন ঘৃণ্য পর্যায়ের মানুষ। সে কারণেই স্কুলের মেয়েদের পুকুরে সাঁতার কাটতে নিয়ে গেলে যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন তাকেই দায়ী হতে হয় এবং সেই জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে আত্মাহুতি দিতে হয়। তার মেয়েটাকে এতিম হতে হয়। সে একে একে মা, নানি, এবং বাবাকে হারায়। মেয়েটির জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা শেষ পর্যন্ত বিকল হয়ে যায়। বাবার মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে সে বিলাপ করতে থাকে-“বাবা জেগে ওঠো।...বাবা মা কথা রাখেনি, নানী কথা রাখেনি, তোমাকে কথা রাখতে দিচ্ছে না এরা। তুমি জেগে ওঠো বাবা...কথা রাখো।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ কথা রাখতে পারল না। 

এই উপন্যাসে মেয়েটির যে কান্না তা আমাদের সমাজের উপেক্ষিত হতভাগ্য প্রতিবন্ধী সমাজের চিরন্তন ক্রন্দন। শুধু প্রতিবন্ধীদের নয় এ কান্না সমাজের সর্বহারা শ্রেণির কান্না, এ কান্না পৃথিবীর নিপীড়িত মানবতার কান্না। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাদা পুলিশরা কালো মানুষকে শ্বাসরোধ ও গুলি করে হত্যা করে তখনও এ কান্না বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। বস্তুত সর্বহারাদের এ চিরন্তন ক্রন্দন! কারণ তারা সমাজের নিগৃহীত, নিপীড়িত মানবেতর জীবনের অধিকারী, যেন তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কাজী শাহেদ আহমেদ এ উপন্যাসে মানবাত্মার এ চিরন্তন ক্রন্দনকেই বাক্সময় করে তুলেছেন।

হতভাগ্য, প্রতিবন্ধী পিতার শোচনীয় মৃত্যুর পর হতভাগী মেয়ের আশ্রয় হলো এক স্নেহময় প্রবীণ শিক্ষকের বাড়িতে। তার পরিবারে আশ্রিত থেকে সে ম্যাট্রিক, আইএ, বিএ ও বিএড পরীক্ষায় গৌরবের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়। তার আশ্রয়দাতা শিক্ষকের পৃষ্ঠপোষকতায় মেয়েদের স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি পায় এবং আনন্দের সঙ্গে শিক্ষকতা পেশায় মনোনিবেশ করে। এ পর্যায়ে পূর্ব নির্ধারিত এক ধনী পরিবারের সন্তানকে তার বিয়ে করতে হয়। তাদের বিবাহিত জীবন ছিল সুখের তবে বিয়ের দু-এক বছরের মধ্যেও সন্তান না হওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। মেয়েটির শ্বশুরের ধারণা ছিল সন্তান জন্মের দায়িত্ব কেবলমাত্র মায়ের, পিতার নয়, সেই কারণে তিনি একটি সন্তানের জন্য অর্থাৎ বংশ রক্ষার জন্য একে একে তিনজন বিবি গ্রহণ করেছিলেন। তার সন্তানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য ছেলেকে সস্ত্রীক ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, লন্ডন ও নিউইয়র্ক পাঠিয়ে জানতে পারেন যে তার পুত্রের কারণেই তার বংশরক্ষা হচ্ছে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি এক রাতে তার পুত্রের অনুপস্থিতিতে নিজেই সন্তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুত্রবধূকে ধর্ষণ করলেন।

এই উপন্যাসের নায়িকা তার শ্বশুরের এহেন ঘৃণ্যকর্ম নীরবে মেনে নিল না। ঘুমন্ত শ্বশুরকে সে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর একটি চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করল। এভাবে মা, নানি, বাবা সবাইকে হারিয়েও জীবনে সে সুখের সন্ধান পেয়েছিল কিন্তু এক কামুক নরপশুর লোভের শিকার হয়ে সব শেষ হয়ে গেল।

কাজী শাহেদ আহমেদের উপন্যাসের শেষাংশে হতভাগ্য নায়িকার কর্মময় জীবনে যে খুশির জোয়ার বয়েছিল তা স্থায়ী হতে পারল না তার স্বামীর নরাধম পিতার লোভ-লালসা ও ঘৃণ্য মানসিকতার জন্য।