১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান স্পেনকে গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত করে। এই সংঘাত বামপন্থী রিপাবলিকান সরকারকে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট-সমর্থিত জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। ইতোমধ্যে জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনি ক্ষমতায় অরোহণের পর বিশ্বজুড়ে স্বৈরাচার-বিরোধীরা আশঙ্কা করেছিলেন যে পরবর্তী পতন হতে পারে স্পেনের, আর তা হলেই ইউরোপীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত হুমকির মুখে পড়বে।
যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো বিশ্বশক্তিসমূহ স্পেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করে, তখন ৫২টি দেশ থেকে ৩৫,০০০ জনেরও বেশি ফ্যাসিবাদবিরোধী স্বেচ্ছাসেবক স্পেনের জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। নাৎসি জার্মানির ইহুদি উদ্বাস্তু, তরুণ জর্জ অরওয়েলের মতো আদর্শবাদী বুদ্ধিজীবী এবং আদর্শিক শত্রুনাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কমিউনিস্টদের তারা অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে স্পেন ভ্রমণের নথিপত্র সংগ্রহ করতে অরওয়েল প্যারিসে থামেন এবং হেনরি মিলারের সাথে দেখা করেন। হেনরি মিলার (১৮৯১-১৯৮০) চল্লিশ বছর বয়সে নিউ ইয়র্ক থেকে ফ্রান্সে এসেছিলেন লেখক হবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। তার বাবা হাইনরিখ মিলার আর মা লুইজা মারি ছিলেন লুথেরিয়ান প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান, তারা জার্মানি থেকে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন। বাবা-মা আর বোন লরেটার সঙ্গে হেনরি মিলার নিউ ইয়র্কের গরীব ব্রুকলিন পাড়ায় বড় হয়েছেন। প্যারিসে কুড়ি শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুই লেখক, জর্জ অরওয়েল এবং হেনরি মিলারের ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতের বিষয়টি উভয় লেখকের গবেষক এবং ভক্তদের একসাথে কৌতূহলী ও বিভ্রান্ত করেছে। মিলারের যতটুকু পরিচিতি তৈরি হয়েছিল সেটি তার রচনার বিষয়বস্তুর কারণে নয়, হয়েছিল ট্রপিক অব ক্যান্সার গ্রন্থটি ঘিরে কেলেঙ্কারির জন্য। অরওয়েল তার 'ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন' গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন এবং কিছু উপন্যাস যা অল্পসংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছেছিল। ১৯৩৬ সালে তিনি স্পেনের ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাওয়ার পথে তিনি প্যারিসের মধ্য দিয়ে পাড়ি দেন। তিনি যদি সেই লড়াইয়ে নিহত হতেন তাহলে আমরা কখনই ‘এনিমেল ফার্ম’ বা ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ এর মতো উপন্যাস পেতাম না। মিলারের জীবনীকার মেরি ভি ডিয়ারবোর্নের সাহায্যে এই সাক্ষাতের বিবরণটি আমরা পাই।
১৯৩৬ সালের বড়দিনের ঠিক আগে জর্জ অরওয়েল জেনারেল ফ্রাঙ্কোর স্বেরাচারী বিদ্রোহবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রজাতন্ত্রের পক্ষকে সমর্থন দিতে স্পেনে রওনা হন। এটি ছিল একটি মারাত্মক অভিজ্ঞতা যা তিনি পরে তার হোমেজ টু কাতালোনিয়া গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। সেখানে যাওয়ার পথে তিনি তার পরিচিত শহর প্যারিসে থামেন। আট বছর আগে সেখানে তিনি বসবাস করেছিলেন যখন তিনি তখনও এরিক আর্থার ব্লেয়ার ছিলেন। প্যারিসের অভিজ্ঞতার বিশদ বিবরণ রয়েছে তার প্রথম গ্রন্থ 'ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস এবং লন্ডন' গ্রন্থে। অরওয়েল স্পেন ভ্রমণের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় ভ্রমণ নথি সংগ্রহ করার পাশাপাশি প্রবাসী আমেরিকান লেখক হেনরি মিলারের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন যিনি ১৯৩০ সাল থেকে প্যারিসে বসবাস করছিলেন। মিলারের 'ট্রপিক অফ ক্যানসার' গ্রন্থের চোরাইপথে আসা একটি পাচারকৃত অনুলিপি পাঠ করেন অরওয়েল। পড়ে খুশি হয়ে আগের বছর একটি নতুন ইংরেজি সাপ্তাহিক সাময়িকীতে গ্রন্থটি সম্পর্কে তিনি একটি পর্যালোচনা লিখেছিলেন। যখন 'ট্রপিক অফ ক্যানসার' পরবর্তী সমানভাবে বিতর্কিত 'ব্ল্যাক স্প্রিং' গ্রন্থটি ১৯৩৬ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয়, তখন অরওয়েল নিউ ইংলিশ উইকলি সাময়িকীতে এই গ্রন্থটিরও একটি পর্যালোচনা লিখেছেন। তিনি গ্রন্থটির শক্তি, সাধারণ মানুষের উপর এর ফোকাস এবং এর খোলামেলা যৌনতা প্রসঙ্গে প্রশংসা করেছিলেন। এর মধ্য দিয়েই দুই লেখকের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠিপত্রের সূত্রপাত হয়। যদিও অরওয়েল এবং মিলার সেদিন একে অপরের সান্নিধ্যে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময় কাটিয়েছেন কারণ অরওয়েলকে স্পেন সীমান্তে পৌঁছে একটি মধ্যরাতের একটি রেলগাড়ীতে উঠতে হয়েছিল। মুখোমুখি এই সাক্ষাৎ হওয়ার বিষয়টি আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি ঘটনা হয়ে রয়েছে। এখানে দুজন তুলনামূলকভাবে অখ্যাত লেখকই ১৯৫০ সালে (অরওয়েলের মৃত্যুর সমসাময়িক কালে) শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং স্বতন্ত্র কণ্ঠে পরিণত হয়েছিলেন। মিলারের বন্ধু এবং বিয়ের বরযাত্রী আলফ্রেড পার্লেস (ওরফে 'জোয়') সেদিনের সেই সাক্ষাতের একমাত্র প্রথম হুবহু বিবরণটি লিখেছেন। বহু বছর পরে লেখা ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত তার একটি দীর্ঘ স্মৃতিকথা 'মাই ফ্রেন্ড হেনরি মিলার' গ্রন্থের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত অন্তর্বর্তী হিসেবে লেখাটি স্থান পেয়েছিল।
অরওয়েল এবং মিলার এরমধ্যে বয়সের পার্থক্যটি লক্ষণীয় ছিল: অরওয়েলের বয়স ছিল তেত্রিশ আর মিলারের ছিল পয়তাল্লিশ বছর। যদিও প্রথমোক্ত জনকে দুজনের মধ্যে বয়স্ক, আরও 'প্রাপ্তবয়স্ক' বলে মনে হয়েছিল। এছাড়া তাদের শারীরিক গঠনের বিষয়টিও ভিন্ন ছিল। অরওয়েল ছিলেন ছিপছিপে লম্বা, প্রায় কৃশকায় চেহারার এবং ইতোমধ্যেই ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত। তিনি ছিলেন একজন ইটন-শিক্ষিত ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীর আচার-ব্যবহার ও কেতাসমৃদ্ধ মানুষ। অন্যদিকে, মিলার ছিলেন একজন পেশিবহুল, উচ্ছ্বসিত, দুর্বিনীত ও কাঠখোট্টা আমেরিকান যিনি কোনোক্রমে উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছিলেন এবং কখনও কলেজে পা রাখেননি। প্যারিসের ভিলা সেউরাতে তার জীবন যাপনে আপেক্ষিক দারিদ্র্য সত্ত্বেও তিনি সুস্থ, হৃষ্টপুষ্ট এবং শক্তিশালী ছিলেন। তাদের উভয়ের লেখার ধরনও ছিল আলাদা। অরওয়েলের গদ্য ছিল পাহাড় থেকে নেমে আসা জলস্রোতের মতো তীব্র, সুনির্দিষ্ট এবং অপ্রতিরোধ্য। আর অন্যদিকে মিলারের লেখাগুলো সারা পৃষ্ঠায় ভালো লাগুক আর নাই লাগুক উচ্ছৃঙ্খলভাবে বর্ণনাত্মক, তার কথা বলার ধরণের মতোই। অর্থাৎ কিছুটা গূঢ় রহস্যময় আধিভৌতিক বিষয় নিয়ে স্বগতোক্তির পর তিক্তভাবে সভ্যতা ও বেশিরভাগ মানব উদ্যোগের নির্বুদ্ধিতার নিন্দা, পরম শান্তিবাদ, বিশ্বজনীন প্রেম, মানববিদ্বেষ এবং ধ্বংসবাদের মধ্যে দোদুল্যমান। রাজনীতি বিষয়ক চিন্তার ক্ষেত্রে, অরওয়েল ছিলেন একজন আদর্শবাদী এবং একজন বিতর্কবাদী। তিনি ছিলেন ভাষার মাধ্যমে একটি উন্নত বিশ্ব তৈরি করার বা অন্তত ফ্যাসিবাদ ও সর্বগ্রাসীবাদকে অস্বীকার করার বিষয়ে স্বপ্নচারী। মিলার ছিলেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, এমনকি রাজনীতি সম্পর্কেও হাস্যকর সারল্যে পূর্ণ এবং বিশ্বকে কীভাবে পরিচালনা করা উচিত সে বিষযে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দিবাস্বপ্নের মতো। একই সময়ে তিনি তার বন্ধু লরেন্স ডুরেলকে লিখেছেন, মিলার বলেছিলেন যে তিনি জার্মানির ক্রমবর্ধমান নাৎসি হুমকির 'সম্পূর্ণ অভিশপ্ত সমস্যা' সমাধান করে দিতে পারেন, যদি তাকে হিটলারের একাকী সান্নিধ্যে থাকার জন্য পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হয়। তিনি কেবল বুড়ো অ্যাডলফকে হাসাতে চান।
অরওয়েলের বারো বছরের জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব সম্পর্কে পয়তাল্লিশ বছর বয়সী মিলারের উপলব্ধি ছিল শিশুদের মতো—আমুদে, বিস্মৃতিপ্রবণ এবং আত্মকেন্দ্রিক। চার বছর পরে প্রকাশিত 'ইনসাইড দ্য হোয়েল' প্রবন্ধে অরওয়েল লিখেছেন, "মিলার সম্পর্কে যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি কৌতূহলী করে তুলেছিল তা হলো তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে কোনোরকম আগ্রহ অনুভব করেননি। তিনি আমাকে বেশ জোরগলায় বলেছিলেন যে সেই মুহূর্তে স্পেনে যাওয়া একটি ডাহা মূর্খের কাজ…গণতন্ত্র রক্ষায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার ধারণাসমূহ তার দৃষ্টিতে একদম অনর্থক ছিল।" মিলারের বন্ধু আলফ্রেড পার্লেস, অনেক বছর পর লেখা তার বিশ্লেষণে উভয় পক্ষের প্রতি আরও উদার ছিলেন: "তাদের ছিল পূর্ব এবং পশ্চিমের মতো পার্থক্য...মিলার ছিলেন দুর্বল এবং নৈরাজ্যকর। বিশ্ব থেকে বৃহত্তর কিছুই তিনি আশা করতেন না। অরওয়েল ছিলেন কঠোর, স্থিতিস্থাপক এবং রাজনৈতিক মানসিকতার অধিকারী। তিনি সর্বদা বিশ্বকে উন্নত ও মানবিক করার পথে সচেষ্ট ছিলেন।"
সুতরাং এক বিবেচনায় আমাদের কাছে জর্জ অরওয়েল ছিলেন নিজেকে অস্বীকারকারী কৃচ্ছ্রতাসাধনকারী ব্যক্তি যিনি কোনো সঠিক উদ্দেশ্যের তরে নিজ জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রত্যয়ী। আর অন্যদিকে হেনরি মিলার, যার (পুরোপুরি সঠিক নয়) চরিত্রটি ছিল মদ, নারী, গান এবং উত্তম ভোজনের তরে নিবেদিত একজন আনন্দবাদী দার্শনিকের মতো, তাও আবার অন্য কোনো গৌরীসেনের টাকায়। নিশ্চিত ভাবে বলা যায় তারা উভয়েই এমন দ্বান্দ্বিকতাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে, শতাব্দীর অবশিষ্টাংশ জুড়ে তাদের বিষয়ে আলোচনা চলমান ছিল—ব্যক্তি স্বাধীনতা বনাম সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ, বিশ্বে নিযুক্তি বনাম এটি থেকে বিচ্ছিন্নতা।
অরওয়েলের আদর্শবাদ এবং 'অপ্রীতিকর ঘটনাগুলির মুখোমুখি হওয়ার শক্তি' সঠিক ছিল কারণ অরওয়েল গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে স্পেনের পথে বা সম্ভাব্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। যখন তিনি মিলারকে তার পরিকল্পনার কথা বলেন, তখন মুহূর্তেই মার্কিন কথাসাহিত্যিকের প্রথম প্ররোচনা ছিল অরওয়েলের যুদ্ধগমন আটকানোর চেষ্টা করা। মিলারের কাছে অরওয়েলের উদ্দেশ্য ছিল একদম অর্থহীন। অরওয়েলের প্রথম জীবনীকার বার্নার্ড ক্রিক দৃশ্যটিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন: "তারা স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। মিলারের কাছে এটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কিছু ছিল। জনসাধারণের বাধ্যবাধকতা, দায়িত্ব এবং সভ্যতার বিষয়ে খামখেয়ালী বিশ্বাসকে প্রতিহত করা যেকোনো ক্ষেত্রে, অরওয়েলের মতো সাহসী বালক স্কাউটরা এর জন্য যা কিছু করেছিল তার চেয়ে খারাপ দিকে নিয়ে যেতে বিপজ্জনক ছিল…অরওয়েলের কাছে, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র একই রেখায় ধাবমান এবং অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিল্পীর স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। তাদের বৈঠকের বিবরণ অনুসারে পার্লেসের ভাষ্য, অরওয়েল মিলারকে বলেছিলেন যে বার্মায় (যখন তিনি এরিক ব্লেয়ার ছিলেন) ব্রিটিশ ইম্পেরিয়াল পুলিশের সদস্য হিসাবে পাঁচ বছর অতিবাহিত করার জন্য তিনি এখনও দোষী বোধ করেন। শুনে মিলার আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন, "এত কিছু সহ্য করার পরেও অরওয়েল কি নিজেকে আরও শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?"
অরওয়েল, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে "যেখানে সমগ্র জনগণের অধিকার এবং অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেখানে আত্মত্যাগের চিন্তা এড়ানো যায় না। তিনি তার বিশ্বাসের কথা এতটাই আন্তরিকভাবে এবং নম্রভাবে বলেন যে মিলার এরপর আর কোনো তর্ক করা থেকে বিরত হন এবং অবিলম্বে তাকে আশীর্বাদ দান করেন। মিলার অসুস্থ অরওয়েলকে একটি কর্ডরয় জ্যাকেটও দিলেন। তিনি এটিকে 'প্রজাতন্ত্রের জন্য তার অবদান' বলে অভিহিত করেন। রসিকতা করে তিনি অরওয়েলকে সতর্ক করেন যে জ্যাকেটটি 'বুলেট প্রুফ নয় তবে এটি আপনাকে উষ্ণ রাখবে।' (এই কথাটি ভবিষ্যদ্বাণীর ন্যায় প্রমাণিত হয়েছিল, কারণ অরওয়েল স্পেনে একজন স্নাইপারের বুলেটে বিদ্ধ হয়ে প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন)।
কয়েক বছর পরে, অরওয়েল যখন ফুসফুসের অসুস্থতার জন্য লন্ডনের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মিলার তাঁকে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাষায় একটি চিঠি লেখেন : "আপনার অসুস্থতার কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখবোধ তাড়িত হয়ে এই চিঠি লিখতে বসলাম। সত্যিই কঠিন ভাগ্য নিয়ে আপনি বেঁচে আছেন বলে মনে হচ্ছে। তবুও আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে পারলে আপনি সবকিছু এমনকি যেকোনো রোগ থেকে বেঁচে থাকবেন—এমনকি প্লেগ থেকেও! এই মুহূর্তে সম্ভবত আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন— বহিরাগত আদর্শের বিষয়ে ভাবনা ও দুশ্চিন্তা বন্ধ করুন। একজন মানুষের পক্ষে এতোকিছু নিয়ে ভাবা অসম্ভব। আপনি পুরো বিশ্বের দায়িত্ব কাঁধে নিতে পারবেন না...কিছুই করতে পারবেন না! শুরুর দিকে এটা খুব কঠিন মনে হলেও—তারপর এটি অবিশ্বাস্য মনে হতে থাকবে। নিজের সম্পর্কে সত্য জানতে পারলে আপনি নিজের মাধ্যমেই বিশ্ব সম্পর্কে জানতে পারবেন। অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু থেকে শুরু করে নিখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেকটি বিষয় জানতে পারবেন। এটা ভুলে যাবেন না।” সম্ভবত অরওয়েল এবং মিলার ১৯৩৬ সালের এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতের চেয়েও পরস্পরের হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি ছিলেন।
স্পেনের সেকেন্ড রিপাবলিককে পরিষেবা দেওয়ার জন্য অরওয়েল ১৯৩৬ সালের বক্সিং ডে’তে বার্সেলোনায় পৌছেন। ৩০ ডিসেম্বরে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টি অব মার্ক্সিস্ট ইউনিফিকেশন বা ‘পাউম’ মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি পাউম ইউনিটে অবস্থান করেন। স্পেনে তিনি জীবনের মৌলিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা প্রমাণের মুখোমুখি হন। এখানেই তিনি স্বচক্ষে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা ও রক্ত-তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেন। দু-একবার তার নিজের ক্ষেত্রেও সেরকম ঘটেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে স্নাইপারের বুলেটে তিনি গুলিবিদ্ধ হন, এর আগেও তিনি একবার তিনি রক্তাক্ত হন। শেষমেশ নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে স্পেন থেকে স্ত্রী আইলিনকে নিয়ে পালিয়ে আসেন।