করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্য
রাচেলকে আমি প্রথম দেখেছিলাম সেন্ট লুইস মাদ্রিদ ক্যাম্পাসের অরিয়েন্টেশন ক্লাসে। স্প্যানিশ মেয়েরা এমনিতেই খুব সুন্দর হয়। তবে রাচেল ছিল অপরূপা। ওকে দেখার পর অবাক হয়ে ভাবছিলাম এই সুন্দরী মেয়েটা হলিউডে না গিয়ে মেডিক্যাল স্কুলে কী করছে?
ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে পটেটাস ব্রেভাস আর পুচেরো অর্ডার দিতেই দেখি রাচেল আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
—হোয়াটস ইউর নেম?
—ফারহানা রহমান।
—রহমান? ডু ইউ হেভ এনি নিক নেম।
—শিরীন।
—শিরি? ওয়াও! হয়ারিজ ইউর ফরহাদ?
—সেলিং গ্রোসারিস...।
—হা হা হা।
এভাবেই মজা করতে করতে একসময় আমরা দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম। ফাইনাল ইয়ারে এসে রাচেল আমাদের আরেক ক্লাসমেট কার্লোসের প্রেমে পড়ে যায়। এমনই উদ্দাম সেই প্রেম যে তিনমাস পর রাচেল আমাকে জানায় সে প্রেগন্যান্ট। কার্লোস আর রাচেলের মেয়ের নাম আমিই দিয়েছিলাম মারিয়া।
পাস করে পালমোনোলোজিতে স্পেশানাইজেশন করে আমি ফুয়েনলেব্রাদা হসপিটালে জয়েন করি। এদিকে রাচেল এবং কার্লোস সার্জন হিসেবে ক্যানারি আইল্যান্ডে নয়েস্টা সিনোরা হসপিটালে জয়েন করে। ওদের মেয়ে মারিয়া, মাদ্রিদে রাচেলের মার কাছে বড় হতে থাকে। মারিয় এখন স্পেনের বিখ্যাত মডেল।
রাচেল ক্যানারিতে চলে যাওয়ার পর থেকে মারিয়াই আমার বন্ধু হয়ে গেছে। এই তো সেদিন ফেব্রুয়ারি মাসে মারিয়ার মাত্র ১০ মাসের ছেলে রোসোকে নিয়ে আমি আর মারিয়া, রাচেল-কার্লোসের কাছে গিয়েছিলাম। এসময়টিতে স্প্যানিশদের সবচেয়ে বড় কার্নিভ্যাল হয় ক্যানারি আইল্যান্ডের সান্টাক্রুজে। কার্লোসের কোলে রোসোকে দিয়ে আমরা তিনজন সে কী উন্মাদের মতো যে নাচানাচি করলাম রাতভর।
চোখের পলোকে চারটা দিন কেটে গেল। ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে ফিরে এলাম আমরা। মাদ্রিদে এসেই পৌঁছাতে না পৌঁছাতে রাচেলের ফোন। শুনতে পেলাম ক্যানারিতেই নাকি কার্নিভ্যালের পর প্রথম একজন জার্মান টুরিস্ট সারস কভ-২-তে মারা গেছে। খবরটি শুনেই দিশেহারা হয়ে গেলাম। আমরা সবাই তো সেই একই কার্নিভ্যালে ছিলাম। এরমধ্যেই ৮ মার্চ উইমেন্স ডে-তে সকালে এসে মারিয়া হাজির। সেদিন ছিল সানডে। ছুটির দিন। মাদ্রিদের রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার নারী র্যালিতে যোগ দিয়েছে। আমরাও সেখানে ছিলাম। দুপুরে ম্যাগডোনালসে খেয়ে মুভি দেখে বাড়ি ফিরলাম।
সেদিনটিই ছিল সম্ভবত আমাদের জীবনের শেষ স্বাভাবিক দিন। এরপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। আস্তে আস্তে হাসপাতালগুলো হয়ে উঠতে লাগল এক একটি লাশের ভাগাড়। ৯ মার্চ আমি ফ্ল্যাট ছেড়ে হাসপাতালের পাশের হোটেলে গিয়ে উঠলাম। মার্চের ১৩ তারিখে পুরো দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হলো। মার্চের ২৮ তারিখে মারিয়া জানাল ওর বাবা-মা দুজনই ক্রিটিক্যাল অবস্থায় ক্যানারির হসপিটালে ভর্তি। দুদিন পর অর্থাৎ ৩০ মার্চ শুনলাম কার্লোস আর নেই। এ যাত্রায় রাচেল বেঁচে গিয়ে আবারও হসপিটাল ডিউটি করছে। এপ্রিলের ৪ তারিখে রাচেলের ফোন। মারিয়ার অবস্থা খুবই গুরুতর। ওকে আমার হসপিটালে ভর্তি করালাম। সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও বুঝতে পারলাম ওর হাতে বেশি সময় নেই। এদিকে দশ মাসের ছোট্ট রোসো গত দুদিন থেকে অনবরত কেঁদেই চলেছে। সে তার মার কাছে যেতে চায়। ছোট্ট রোসোর অবর্ণনীয় সেই ব্যাকুল হেঁচকিসহ কান্না হাসপাতালের প্রতিটি ডাক্তার, প্রতিটি নার্সকে অসহায়ত্বের এমন এক বিষাদ সাগরে ভাসিয়ে দিল যা হয়তো স্বাভাবিক অবস্থার কোনো মানুষের পক্ষে বোঝা কখনো সম্ভব হবে না।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে মারিয়াকে অক্সিজেন মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরিয়ে সারা শরীর ফয়েল পেপার দিয়ে ঢেকে দিয়ে ওর বুকের ওপর বাচ্চাটাকে দেয়া হলো। আর তাতেই হেঁচকি থামিয়ে শিশুটি মায়ের বুকের ওপর চুপ হয়ে লেপটে রইল। মারিয়া তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে বুকের ওপর রোসোকে ধরে আছে। কয়েকদিন থেকেই বুঝতে পারছিলাম আমারও সময় শেষ হয়ে আসছে। তাই শিশুটির কাছে না গিয়ে দূর থেকেই মা-ছেলেকে খেয়াল করছিলাম। একসময় বুঝতে পারলাম মারিয়ার হাত ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে। আমি নার্সকে ডেকে মারিয়ার কাছ থেকে শিশুটিকে সরিয়ে নিতে বললাম। আর এলোমেলো পায়ে তন্নতন্ন করে একটি ফাঁকা জায়গা খুঁজতে লাগলাম। যেখানে গিয়ে অন্তত শেষবারের মতো আমার দুর্বল ফুসফুসটি খালি করে বিকট একটি চিৎকার দিয়ে মাটির বুকে শুয়ে পড়তে পারি।