আট তলায় জীবিত লোক আছে!

রানা প্লাজা ধসের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তাসলিমা বেগম, বলছেন সেই কথারানা প্লাজার দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত তাসলিমা বেগমের দিন কাটে এখন ঘরে বসে। তিনি এখনও থাকেন সাভারেই। স্বামী রিকশা চালায়। অভাবের সংসারে কেবল স্বামীর উপার্জনে হয় না। তাই ১৬ বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছেন গ্রাম থেকে, কাজে দিয়েছেন গার্মেন্টে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে সেখানকার পাঁচটি তৈরি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হন। ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে গুরুতর আহত পঙ্গু হন কয়েক হাজার শ্রমিক। তাসলিমা বেগম তাদেরই একজন।

সেদিনের ঘটনা শুনতে চাইলে চার সন্তানের মা তাসলিমা একনাগাড়ে বলেন, ‘সকালবেলায় কাজ শুরু করছি। এর মধ্যেই ধুম ধুম শব্দ। সবাই চারপাশে এদিক-ওদিক তাকাই, ভাবি কুন থাকি শব্দ আসে? কিছু না বুঝতেই কেউ একজন খালি কয়— ‘তোমরা বেরোও, গার্মেন্ট ভাইঙ্গা গেছে।’ তখন কেবল দুই-তিন পা বাড়াইছি আর পাশ থেকে একটা বীম পড়লো। ছাদ পড়লো মাথার ওপর। একটা রড আমার মাথায় ঢুইকে গেলো। বীমের নিচে আমরা। কোনওদিন ভাবি নাই বাইচে ফিরুম। মরণ দেইখ্যা আসছি, খালি কাফনের কাপরডা পরায় নাই।’

সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক অনুষ্ঠানে কথা হয় তাসলিমা বেগমের সঙ্গে। তার তিন মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েরা ১৬ বছর ও ১১ বছরের। আর আট বছরের ছেলেটি শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার কোলে ৯ মাসের শিশুকন্যা। সংসার এত বড় করলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আত্মীয়স্বজনরা সবাই বলে— ‘দুই মেয়ের বিয়ে হয়ি যাবে, ছেলেটা পঙ্গু (প্রতিবন্ধী), আরেকটা সন্তান যদি ছেলে হয় তাইলে বয়সকালে সে দেখতে পারবো।’ কিন্তু কী কপাল, হলি (হলো) আরেকটা মেয়ে।”

রানা প্লাজা ধসের পরের ঘটনা জানতে চাইলে তাসলিমা বলেন, ‘ছাদের নিচে পড়ি আছি, কোনও দিকে শরীর ফিরাইতে পারি না। মাথার মধ্যে দিয়া রড গেছে, রক্তে চোখমুখ বন্ধ হইয়া গেছিল। চারপাশে কেবল চিক্কুর (চিৎকার), খালি ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ শব্দ। কানতেও ভুইল্যা গেছি, শব্দ বাইর হয় না মুখ দিয়া। বীমের নিচে একটুখানি ফাঁকা আছিল, অনেকক্ষণ পর সেই ফাঁকা দিয়া হাতটা কেবল বাড়াইলাম। মানুষরে ডাকলাম, বাপরে ডাকলাম, ভাইরে ডাকলাম। কেউ সাড়া দেয় না। কিছুক্ষণ পর কানে শব্দ আইলো— ‘আট তলায় জীবিত লোক আছে, হাত দেখা যায়।’

কিছু সময় পর উদ্ধারকারীরা আসেন জানিয়ে তাসলিমা বলেন, ‘ভাঙা বীমের বড় বাইয়া কয়েকজন লোক আইলো। মাঝবয়সী একজন আমারে কইলো— ‘মা তুমি বেঁচে আছো, তুমি ভয় পেও না, আমরা চলে আসছি।’ কিন্তু তারা তো আমারে বাইর করতে পারে না, পারবো ক্যামনে, আমি তো বীমের নিচে। সে কি কষ্ট গো! হেরা আমারে টানে, কিন্তু আমি তো বাইর হইতে পারি না। পরে আরও মানুষ আইলো। সবাই মিলা বীমটারে কোনোরকম উচা (তুলে) কইরা আমারে টান দিলো। আমি খালি তখন মাঝবয়সী লোকটার গলা জড়াইয়া ধরলাম। আর কিছু আমার মনে নাই। পরে জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালে। মাথায় অপারেশন হইছে। প্রায় মাসখানেক পর হাসপাতাল থেকে ফিরি। আমার স্বামী বড় ভালা মানুষ। সে আমারে দেইখা রাখছে। নিজের হাতে ওষুধ খাওয়াইছে। রিকশা চালাইয়া শ্বশুর-শাশুড়ি আর আমাদের ছয় জনের সংসার সে দেখে রাখতেছে।’

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সহযোগিতায় পশুপালনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাসলিমা। এর অংশ হিসেবে দুই দফায় তিনি পেয়েছেন ৯০ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে জমিবন্ধক রেখেছেন। তাসলিমা বলেন, ‘আপনার মতো সবাইরে এই তিন বছর ধইরে কথা বইলা যাই, কিন্তু কোনও সহায়তা পাই না। কথা না শুইনা যদি সবাই আমারে একটা বা দুইটা গরু কিন্যা দিতো, তাইলে একটু ভালো থাকতে পারতাম। না খাইয়া থাকতে হইতো না।’

আরও পড়ুন-
রানা প্লাজা ধসের ৪ বছর: আজও শঙ্কা কাটেনি আহত শ্রমিকদের

রানা প্লাজার পিলার ভাঙতে শুরু করে দুর্ঘটনার আগের দিনই

রানা প্লাজা ধস: পঙ্গুত্বের কারণে ভেঙেছে অনেকের সংসারও

রানা প্লাজার তিন মামলা: বিচার বিলম্বিত যে কারণে

শত বাধা আর কষ্টেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা

ডায়েরি থেকে রেশমাকে উদ্ধারের অভিযান

/জেএইচ/