অঘোষিত ‘লকডাউন’: জীবিকার তাগিদে সড়কে শ্রমজীবী মানুষ




করোনা বিস্তার রোধে সরকার ঘোষিত ছুটিতে রাজধানীসহ পুরো দেশ রয়েছে অঘোষিত ‘লকডাউন’ অবস্থায়। ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া নাগরিকদের ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। দুই জনের একসঙ্গে চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা। এ অবস্থায় খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছেন বিপাকে। ‘লকডাউন’ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞা না মেনেই বের হচ্ছেন তারা, তবে কাজ মিলছে না তাদের।

শুক্রবার (২৭ মার্চ) দিনভর নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তায় বের হওয়া মানুষের প্রায় সবাই জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে বের হয়েছেন। তবে তাতেও খুব একটা সাড়া পাচ্ছেন না। নাগরিকদের কেউ রিকশা বা গণপরিবহন ব্যবহার করে যাওয়ার মতো কাজে যোগ দিচ্ছেন না। যারা একান্তই জরুরি প্রয়োজনে বের হচ্ছেন, তারাও স্বল্প দূরত্বের পায়ে হাঁটা পথে বের হচ্ছেন। রিকশা, সিএনজি বা অন্য কোনও বাহন তারা ব্যবহার করছেন না।

সকালে খিলগাঁও রেলগেটে কথা হয় বেশ কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে। তাদের একজন সমীর মিয়া। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্ত্রী ও সন্তানসহ ছয় জনের পরিবার চালাতে হয়। আয় না করে বাসায় ফিরলে রাতে উপোস থাকতে হবে। সে কারণে রাস্তায় রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। কিন্তু আমার মতো এমন বহু রিকশাচালক রয়েছেন, যাদের ঘরে কোনও খাবার নেই। রিকশার চাকা ঘুরলে আমাদের সংসারের চাকা ঘোরে। কিন্তু এখন কোনও যাত্রী নেই। মানুষ ঘর থেকে তেমন একটা বের হচ্ছেন না। বের হলেও তারা রিকশা বা সিএনজি ব্যবহারের মতো দূরত্বে যাচ্ছেন না। ভোর থেকে এখন পর্যন্ত (বেলা ১২টা) মাত্র ৮০ টাকা ভাড়া পেয়েছি।

করোনা১সন্ধ্যা ৭টার দিকে পান্থপথে কথা হয় আরও কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে। তাদের একজন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ঘরে বসে থাকলে পরিবার চালাবো কীভাবে? আমাদের তো ঘরে কোনও কিছুর স্টক নেই, সেই সামর্থ্যও নেই। তাই পেটের তাগিদে বের হয়েছি। সারা দিনে ১৫০ টাকা ভাড়া পেয়েছি। বলেন, এই যুগে এই টাকা দিয়ে কী হয়?

দুপুরে নগরীর বাংলামোটর এলাকায় কথা হয় সিএনজি-চালক রমজান উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, মালিককে প্রতিদিন ৯০০ টাকা জমা দিতে হয়। এই টাকা উঠিয়ে গ্যাসের বিল ও নিজের হাতখরচের পর বাকি টাকা আয়। কিন্তু এখন মালিকের জমার টাকাই উঠাতে পারছি না। আর সিএনজি নিয়ে রাস্তায় না নামলে মালিক জানিয়ে দিয়েছে পরে আর গাড়ি দেবেন না। তাই ভবিষ্যৎ চিন্তা আর পেটের তাগিদে রাস্তায় নেমেছি।

ফকিরাপুলের ওয়াসা কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা গেছে বেশ কয়েকজন মানুষ কাজের সন্ধানে বসে আছেন। এদের সবাই দিনমজুর। কিন্তু বেলা ১২টা পর্যন্ত তাদের কেউই শ্রম বিক্রি করতে পারেননি।

এদের একজন মেহেরাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, গত পাঁচ দিন কাজের সন্ধানে বের হয়েছি, কিন্তু কাজ পাইনি। আজ রাতে কী খাবো, সেই চিন্তায় রয়েছি। বাসায় খাবার থাকলে এই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় বের হতাম না।

এর আগে বিকাল সাড়ে চারটায় নগরীর গুলিস্তানে সিটি করপোরেশনের নিয়মিত জীবাণুনাশক গাড়ির কার্যক্রম পরিদর্শন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। এ সময় তাকে দেখতে পেয়ে আশপাশের বস্তিবাসী সাহায্যের আকুতি জানান। তাদের সবাই জানান কোনও কাজকর্ম নেই, সে কারণে তারা রাস্তায় বের হয়েছেন। রাতের খাবার দিয়ে সাহায্যের আকুতি জানান তারা। এ সময় মেয়র প্রত্যেককে নগদ অর্থসহায়তা দেন।

এদিকে দুপুরে জুমার নামাজ জামায়াতে আদায়ে শত শত নগরবাসী ঘর থেকে বের হন। তারা সবাই করোনা থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন। তবে এর বাইরে কেউ তেমন একটা বাসা থেকে বের হননি। নগরীর প্রায় সব দোকানপাট ছিল বন্ধ। তবে এলাকাভিত্তিক জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দুই-একটি দোকান খোলা থাকতে দেখা গেছে।

এছাড়া সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় করোনা সচেতনতায় প্রচারাভিযান চালিয়েছে। এ সময় তারা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে রাস্তায় বের হতে নিষেধ করেছেন। কোথাও মানুষের জটলা দেখলে তা ছত্রভঙ্গ করে দিতেও দেখা গেছে।

ছবি: শাহেদ শফিক ও নাসিরুল ইসলাম