X
রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২

হোসেনি দালান: কারবালার শহীদদের প্রতীকী নিদর্শন

মহসীন কবির
০৬ জুলাই ২০২৫, ০৭:০০আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৭:০০
হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম, ইসলামের প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.) কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। এই শোকাবহ ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বে মুসলমানরা আশুরা পালন করেন। এই স্মৃতিকে ধারণ করেই সপ্তদশ শতকে সম্রাট শাহজাহানের আমলে ঢাকায় নির্মিত হয় হোসেনি দালান।

প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটি অবস্থিত পুরান ঢাকার চাঁনখারপুলে, হোসেনি দালান রোডে। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘ইমামবাড়া’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ একে ‘হুসনি দালান’ বা ‘হোসায়নি দালান’ বলেও উল্লেখ করেন। এটি মূলত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি মসজিদ ও কবরস্থান, এবং বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব মহররম পালনের প্রধান কেন্দ্র।
হোসেনি দালানের ‘ইমামবাড়া’য় ভক্তরা (ছবি: প্রতিবেদক)
 
সৌন্দর্যে অনন্য হোসেনি দালান
দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য ও স্থাপত্যশৈলীতে গঠিত এই দালানটি কোনও মাজার না হলেও প্রতীকীভাবে এখানে রয়েছে হযরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর রওজার অনুরূপ একটি সোনালি কফিন। কালো কাপড়ে মোড়ানো দেয়াল ও পবিত্র কোরআনের আয়াত খচিত অলংকরণ কারবালার শোকাবহ আবহ সৃষ্টি করে। অনেকে সেখানে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে দোয়া করেন, কেউবা ভালোবাসার উপহার জড়ান সেই প্রতীকী কফিনে।

হোসেনি দালান পরিচালনা কমিটির সুপারিনটেনডেন্ট এম এম ফিরোজ হোসেন ইতিহাসের বরাত দিয়ে জানান, প্রায় ৪০০ বছর আগে তৎকালীন ঢাকার সুবেদার শাহ সুজার নৌবাহিনীর প্রধান মীর মুরাদ এক রাতে স্বপ্নে হযরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর কারবালার ঘটনার স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের নির্দেশনা পান। সেই স্বপ্ন অনুসারে তিনি ১৬৪২ সালে স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। প্রাথমিকভাবে এর নাম ছিল ‘দালানে মোকাদ্দাসে হোসাইনী’—অর্থাৎ ‘পবিত্র হোসাইনী দালান’।
 
হোসেনি দালানের ‘ইমামবাড়া’ (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)
 
স্থাপত্য ও পরিকাঠামো
প্রায় ছয় বিঘা জমির ওপর নির্মিত হোসেনি দালান দুই ভাগে বিভক্ত—বাহিরাংশ ও ভেতরের অংশ। ভেতরের ডানদিকে রয়েছে ‘গাঞ্জে শহীদ ঘর’, যেখানে কারবালার ৭১ শহীদের স্মৃতি ধারণ করা হয়েছে। মহররম মাসের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এখানে ১০ দিনব্যাপী সকাল-বিকাল ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও নহজত (শোকসংগীত) পরিবেশিত হয়।

প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে দেখা মেলে—ভিতরে ডানপাশে একটি ভবন, যেটি ‘কোতওয়ালি’ নামে পরিচিত। দু’পাশ দিয়ে প্রবেশ করা দেয়ালে রয়েছে ছোট ছোট খোপ, যেখানে মোহররমে চেরাগবাতি জ্বালানো হয়। আরও রয়েছে খোলামেলা মাঠ, দক্ষিণে নানা প্রজাতির মাছসমৃদ্ধ পুকুর, পশ্চিমে ঢাকার খ্যাতনামা ব্যক্তিদের কবরস্থান এবং পূর্ব পাশে নাজিমদের সমাধিসৌধ।

ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে ইমামবাড়ার অফিস, নিচতলায় একটি শিশু মাদ্রাসা এবং উত্তর-পশ্চিমে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। স্থাপনাটি শুধু ধর্মীয় নয়—এটি বাংলার নান্দনিক ঐতিহ্যেরও এক জীবন্ত নিদর্শন।
 
হোসেনি দালান (ছবি: প্রতিবেদক)
স্থাপত্যশৈলী ও ইরানি সংযোগ
হোসেনি দালানে মোগল, পর্তুগিজ, ব্রিটিশ ও বাংলা স্থাপত্যের সমন্বয় দেখা যায়। ইরান বাহবার থেকে আগত আয়াতুল্লাহ সাহরুখি খোররামবাদি নিজস্ব কারিগরের মাধ্যমে এটি নির্মাণ করান। এখানে ব্যবহৃত কোরআনিক আয়াতসম্বলিত টাইলস ও কারুকার্যের অনেক অংশই আনা হয়েছে ইরান থেকে।

পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ
বর্তমানে হোসেনি দালানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুটি কমিটি কাজ করছে—একটি প্রধান কমিটি ও একটি উপ-কমিটি। প্রতিষ্ঠার পর মীর মুরাদ নিজেই এর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। পরে তৎকালীন ঢাকার শাসকরা, যারা অধিকাংশই শিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, সরকারিভাবে এটি পরিচালনা করেন।
 
স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে এর দায়িত্ব পান সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ। তার মৃত্যুর পর দায়িত্ব পান সাদরী ইস্পাহানী, তারপর তার পুত্র বেহরাজ ইস্পাহানী, এবং বর্তমানে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন সালমান ইস্পাহানী। পদাধিকারবলে এর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ঢাকার এডিসি (রেভিনিউ)।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা মির্জা মো. নাকী (আসলাম) জানান, শিয়া সম্প্রদায় কর্তৃক পরিচালিত হলেও কারবালার শহীদদের প্রতি সকল ধর্ম ও মতের মানুষের অগাধ ভালোবাসার কারণে এখানে সর্বসাধারণ আসেন। বিশেষ করে মহররম মাসে এখানে ভক্তদের ঢল নামে। এটি একটি সর্বজনগ্রাহ্য ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যা জনগণের অর্থায়নে পরিচালিত হলেও সরকারি সাহায্য খুবই সীমিত।
 
 
হোসেনি দালানের সামনে ভক্তদের ভিড় (ছবি: প্রতিবেদক)

ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিল
১০ মহররম মুসলমানদের কাছে একটি বিশেষ দিন। শিয়া সম্প্রদায় এদিন একটি ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিল আয়োজন করে, যা ঢাকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। ‘হায় হোসেইন, হায় হোসেইন’ মাতম করতে করতে এই মিছিল হোসেনি দালান থেকেই শুরু হয়।

শিয়া সম্প্রদায়ের মতে, এ দিনেই মহান আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন এবং ভবিষ্যতে এ দিনেই ধ্বংস করবেন। আবার এ দিনেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) শহীদ হন। সেই কষ্ট ও শোক অনুভবের জন্য অনেকে তাজিয়া মিছিলে নিজ শরীরে আঘাত করেন—শোক ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে।

/এএইচএস/ইউএস/আরআইজে/
সম্পর্কিত
তিন বিভাগে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, কোথাও কোথাও ভূমিধসের শঙ্কা
রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে জনতা ব্যাংকের ডিজিএম নিখোঁজ
পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিলে অনুরাগীদের ঢল
সর্বশেষ খবর
৯০তম জন্মদিনে আরও ৪০ বছর বাঁচাতে চান দালাই লামা
৯০তম জন্মদিনে আরও ৪০ বছর বাঁচাতে চান দালাই লামা
ভাষানটেকে শিশুর মরদেহ উদ্ধার
ভাষানটেকে শিশুর মরদেহ উদ্ধার
র‌্যাগিং: সিভাসুর ১৯ শিক্ষার্থীকে হল থেকে বহিষ্কার, ২ জনের ছাত্রত্ব বাতিল
র‌্যাগিং: সিভাসুর ১৯ শিক্ষার্থীকে হল থেকে বহিষ্কার, ২ জনের ছাত্রত্ব বাতিল
সেই ব্যাংক কর্মকর্তার খোঁজ মিলেছে
সেই ব্যাংক কর্মকর্তার খোঁজ মিলেছে
সর্বাধিক পঠিত
প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু
প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু
সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হাত: চাপের মুখে প্রবীণ ও মধ্যবিত্তরা
সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হাত: চাপের মুখে প্রবীণ ও মধ্যবিত্তরা
আসছে নতুন কারিকুলাম: ফ্রেমওয়ার্ক ডিসেম্বরে, ‘বড় পরিসরে’ থাকবে জুলাই
আসছে নতুন কারিকুলাম: ফ্রেমওয়ার্ক ডিসেম্বরে, ‘বড় পরিসরে’ থাকবে জুলাই
কনস্টেবলকে ‘স্যার’ ডেকে ধরা পড়লেন ভুয়া এসআই
কনস্টেবলকে ‘স্যার’ ডেকে ধরা পড়লেন ভুয়া এসআই
আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে প্রতীকী কফিন মিছিল
আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে প্রতীকী কফিন মিছিল