আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপাত্ত অনুযায়ী ২০১৭-২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯-২০২০ সালে দেশে ধর্ষণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৬ সালে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৭২৪টি, ২০১৭ সালে ৮১৮, ২০১৮ সালে ৭৩২, ২০১৯ সালে ১৪১৩ এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা পাওয়া যায় ৯৭৫টি। অর্থাৎ ২০১৯ ও ২০২০ সালে গড়ে প্রতিদিন ৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যেখানে ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল দুই জন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এপ্রিল থেকে ধর্ষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরের মার্চ মাসে ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা ছিল বছরের সর্বনিম্ন। এই মাসে ৬৭টি ধর্ষণের ঘটনা পাওয়া যায়। এরপর প্রতি মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাসে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৭৬, মে মাসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪-তে। জুনে ধর্ষণের পরিমাণ মারাত্মক হারে বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৬-এ। যা মার্চ মাসের সংখ্যার থেকে প্রায় তিনগুণ বেশি। এরপর জুলাই ও আগস্ট মাসেও এই বৃদ্ধি জারি থাকে। জুলাই ও আগস্ট মাসে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪০টি ও ১৪৮টি। সেপ্টেম্বরে এই সংখ্যা ছিল ৮৬টি। এই হ্রাসের কারণ হিসেবে আন্দোলন ও পুলিশি তৎপরতা একটি প্রভাবক হতে পারে।
২০১৯ সালের মাসওয়ারি বিশ্লেষণেও একই প্যাটার্ন দেখা যায়। বছরের শুরুতে ধর্ষণের সংখ্যা কম থাকে কিন্তু এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা বেশি পাওয়া যায়।
এছাড়া ২০১৯ সালে পুরো বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪১৩ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। এমনকি ধর্ষণের পর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ১০ জন। বয়সভিত্তিক চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, ৬ বছর থেকে ১৮ বছরের শিশু-কিশোরেরা সবচাইতে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পুরো বছরে ১৪১২ জনের মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৫৬২ জনের বয়স আঠারো বছরের নিচে।
ঠিক একই চিত্র ২০২০ সালেও। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৭৫ জন ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে ৩৯৯ জনের বয়স আঠারোর নিচে। ধর্ষণের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় ধর্ষকদের প্রধান টার্গেটই থাকে আঠারো বছর বয়সের নিচে।
১৮ বছরের নিচে ধর্ষণের সংখ্যা বেশি কেন প্রশ্নে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠান ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্সের প্রধান নির্বাহী রোকসানা সুলতানা বলেন, এই বয়সী কিশোরীদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। তাদেরকে নির্যাতনকারী নানা রকমের কথা দিয়ে, সম্পর্ক স্থাপন করে বশে আনতে পারে। কারণ কিশোর বয়সে বয়ঃসন্ধিকালে বাড়তি আবেগ ও কম যুক্তি কাজ করে। এবং কোনও একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে কিশোরীরা কারোর সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। তার প্রতিষ্ঠানের গবেষণার উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, এর চেয়েও কমবয়সীদের ধর্ষণ সংখ্যা বেশি দেখা যায় কারণ শিশুদেরকে পরিবারের কাছের মানুষেরা নির্যাতন করে বেশি। চকলেট বা ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে। শিশুটি ব্যথা না পেলে বা খারাপ ছোঁয়া বিষয়ে বুঝতে না পারলে একাধিকবার তাকে ধর্ষণ করতে পারে। এবং শিশুদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যায়। আঠারো বছরের ওপরের ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীর বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়, অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারে।
অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হলে ধর্ষণ কমবে বলে মনে করেন না আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে সর্বোচ্চ সাজা আছে সেটাই আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। মৃত্যুদণ্ড দিলে সেটি যদি কার্যকর করা সম্ভব না হয় তাহলে আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে আসলে কিছু পাওয়া যাবে না। তবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ভয় দেখানোর জন্য। প্রশ্ন হলো, আদৌ সাজা হবে বলে ধর্ষক মনে করে কিনা।
ধর্ষণ সবসময়ই আছে তারপরও কোনও কোনও ধর্ষণের ঘটনা ইস্যু হয়ে উঠলে আন্দোলন গড়ে ওঠে কেন প্রশ্নে নারী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ফৌজিয়া খন্দকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কেন ইস্যুভিত্তিক সেটা আমরাও বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি। তবে আন্দোলন সবসময় হবে সেটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বহুদিনের ক্ষত যখন আপনাকে বিক্ষুব্ধ করবে তখনই মাঠে নামবেন। রাজনৈতিক আন্দোলনও ইস্যুভিত্তিকই হয়। নারী নির্যাতন দমন প্রতিরোধে আজকের যেই আইন সেটি নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আসা একটি আইন। ফলে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন নিয়ে সমালোচনার জায়গা নেই। প্রশ্ন হলো, আমাদের অর্জন কতোটা আনতে পারছি।