মহামারিকালে শহরে নারীর কাজ বেড়েছে ১২৮ শতাংশ

দেশে ২০২০ সালের করোনাকালে শহর ও গ্রাম মিলিয়ে ৪৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ পরিবার থেকে অন্তত একজন কাজ হারিয়েছেন, বা কাজ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন শহরের ৭৩ দশমিক ৩ ভাগ মানুষ এবং গ্রামের ৯২ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ। এছাড়া রান্না করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ধোয়ার কাজ গ্রামীণ নারীর মতো হলেও আশ্চর্যজনকভাবে এই মহামারির সময়ে শহরে নারীর কাজ বেড়েছে ১২৮ শতাংশ।

‘বাংলাদেশে ২০২০-এ করোনা চলাকালে সংসারের সেবাকাজের দ্রুত বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। এই সময়ে গ্রাম ও শহরের পরিবারগুলোতে কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, দারিদ্র্যের হার কতটা বেড়েছে, নারীর আয় কতটা কমেছে, ঘরে নারী-পুরুষের কাজের আনুপাতিক হিসাব, ইত্যাদি তুলে ধরার লক্ষ্যে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’।

শনিবার (২৪ এপ্রিল) এক ওয়েবিনারে এই তথ্য ধরে সংস্থাটি।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জানায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের মধ্যে শতকরা ৭৬ জন বলেছেন যে, মহামারির সময়ে তাদের পরিবারের আয় কমে গেছে। ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা উপার্জনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৬৮ জনের আয় কমেছে। এর অর্থ হচ্ছে— এই মানুষগুলো দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছেন। ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জনকারীদের শতকরা ৭৩ জনের আয়ও  হ্রাস পেয়েছে। দেখা গেছে, কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো থাকলেও, যারা অকৃষি কাজের জড়িত জড়িত, অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ।

জরিপের তথ্যে আরও বলা হয়, শতকরা ৭৭ দশমিক ৭৮টি নারীপ্রধান পরিবার অর্থনৈতিক অনটনে পড়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই অনানুষ্ঠনিক খাতের। নারীদের অনেকেই কাজ বা চাকরি হারিয়েছেন। পাশাপাশি বেড়েছে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঘরের কাজের চাপ। বাংলাদেশে কাজে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে শতকরা ৯১ দশমিক ৩ জন অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এদের শতকরা ৯৬ দশমিক ৭ জন নারী। 

জরিপের তথ্য বলছে, যখন অভাবের কারণে  শতকরা ৮৫ ভাগ কর্মজীবী নারী অমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজে অনেকটা সময় দিয়েছেন এবং সেটা ৪ ঘণ্টারও বেশি সময়। শহরের নারী উত্তরদাতাদের কাছে গৃহস্থালি কাজের মধ্যে প্রথমদিকে আছে স্বামীর যত্ন করা। এরপর আছে সন্তান ও পরিবারের অন্যদের দেখাশোনা করা। করোনার আগে গৃহিনীদের মধ্যে শতকরা ৭১ দশমিক ৫ জন সাধারণত ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় অমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজে ব্যয় করতেন। করোনাকালে এসে এদের মধ্যে শতকরা ৩৭ দশমিক৮ জনের কাজের সময় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণও বেড়েছে। নারীর ঘরে কাজের পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টার কাজ ৬/৭ বা ৮ ঘণ্টার কাজের তালিকায় পৌঁছে গেছে।

সংস্থাটি জানায়,  পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ফোরাম ‘ফরমাল রিকগনিশন অব দ্য ওম্যান’স আনকাউন্টেড ওয়ার্ক’ এর উদ্যোগে এই জরিপটি পরিচালনা ও তৈরি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শারমিন্দ নিলোর্মী। এই ফোরামের সদস্য সংস্থাগুলো হচ্ছে— অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ, অক্সফাম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে  সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেখতে হবে এই অনানুষ্ঠানিক কাজকে আমরা কীভাবে জাতীয় ডেটা বেইজে সন্নিবেশিত করতে পারি। আমরা নারীর এই শ্রমকে আসন্ন অর্থবছরের এসএনএ-তে যোগ করতে চাই। নারী যে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় কাজ করছে, সেটারও একটা মনিটরিং ভ্যালু বের করতে হবে।’

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সোকো ইশিকাওয়া বলেন, ‘ইউএন ওম্যান সবসময় এই কাজের সঙ্গে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে আমাদের ভাবতে হবে— নারীর এই কাজকে আমরা কীভাবে দৃশ্যমান করবো।’

সভা প্রধানের বক্তব্যে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘নারীর কাজকে দায়িত্ব মনে না করে যেদিন কাজ বলে মনে করতে শিখবো, সেদিনই নারীর কাজের মূল্য যোগ হবে।’

অনুষ্ঠানে প্রধান বিশেষ অতিথি ছিলেন— ইউএন উইম্যানের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ সোকো ইশিকাওয়া, জরিপের ওপর আলোচনা করেন  সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এবং  ফিন্যান্স ডিভিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি মেহেদী মাসুদুজ্জামান। আরও বক্তব্য রাখেন— বিএনপিএস-এর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সারাহ কবীর এবং অক্সফামের উইম্যান এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড কেয়ার প্রোগ্রামের ম্যানেজার সার হল।