বিএডিসি পর্ব- ২

ফসল উৎপাদনে কোটি টাকার লোকসান খোদ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনেই!

নানা অনিয়মের মধ্যে চলছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। এ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব থাকছে আজ।

কৃষকদের বাম্পার ফলন কিংবা খামার করে লাখপতি হওয়ার খবর শোনা যায় প্রায়ই। বাংলাদেশের আবহাওয়া কৃষিকাজের জন্য বরাবরই অনুকূলে। কিন্তু খোদ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনই কৃষিতে লোকসান গুনছে কোটি টাকা!

বিএডিসির নিয়ন্ত্রণে থাকা ১৩টি প্রতিষ্ঠানে চাষাবাদ হয়। তার প্রতিটিতেই আয়ের চেয়ে ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি দেখা গেছে। ফসল ফলাতে গিয়ে সংস্থাটির প্রায় দুই কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকারও বেশি লোকসান হয়েছে। এ ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৫ থেকে ২০১৯ অর্থবছরে। সরকারি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিএডিসি বলছে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে টাগের্ট অনুযায়ী ফসল উৎপাদন না হওয়ায় লোকসান হয়েছে।

সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নতমানের বীজ, পর্যাপ্ত সার, কীটনাশক ও শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে উৎপাদিত ফসলের মূল্য কম হওয়ার যুক্তি নেই। তাছাড়া অবহাওয়া বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রমাণও পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় দায় দায়িত্ব নির্ধারণ করে ক্ষতির অর্থ আদায় করতে সংশ্লিষ্ট দফতরকে বলা হয়েছে।

কোন খামারে কত ক্ষতি

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিএডিসির কুমিল্লার সৈয়দপুর উন্নয়ন কেন্দ্রে উৎপাদিত চারা, কলম, কাটিং, বীজ, ফল ও সবজি বিক্রয় বাবদ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অপরদিকে বীজ, চারা, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় দেখানো হয়েছে হয়েছে ৪৩ লাখ ২৮ হাজার ও ৮৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এ দুই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি ৮৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

খুলনার মহেশ্বরপাশা বিএডিসির অ্যাগ্রো সার্ভিস সেন্টারে সবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনে ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। কিন্তু ওই সবজি-ফসল বিক্রি করে আয় হয়েছে মাত্র ৫৫ হাজার ৮৮২ টাকা।

ঝিনাইদহের দত্তনগর করিঞ্চা বীজ উৎপাদন খামারের ব্লক সির তিন একর জমিতে ২০১৮-১৯ উৎপাদন বর্ষে বিএডিসি-১ মটরের চাষ হয়। উৎপাদন খরচ ৬০ হাজার টাকার কিছু বেশি। কিন্তু বিক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৪০ টাকা।

একই জেলার মহেশ্বরপাশা বিএডিসি অ্যাগ্রো সার্ভিস সেন্টারে ২০১৫-১৯ সালের বিল ভাউচার এবং অন্যান্য রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেন্টারটির কৃষিখাতের ব্যয়ের মধ্যে বীজ, চারা, কলম করা, কীটনাশক, সার, পোনা ক্রয়, মজুরি, সেচযন্ত্র মেরামত ও উদ্যান সামগ্রী ক্রয় বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। অপরদিকে, এসবখাতে উৎপাদিত ফসল, বীজ, চারা বিক্রি করে আয় হয়েছে মাত্র ৫৬ লাখ ২৩ হাজার টাকা।

মেহেরপুরের বারাদী বীজ উৎপাদন খামারে ২০১৭-১৯ উৎপাদন বর্ষে কাল্টিভেশন রেজিস্টার ও আনুষঙ্গিক বিল ভাউচার পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, খামারের এ, বি ও সি ব্লকে বীজধান ও আলুবীজ উৎপাদনের জন্য বীজ, সার, কীটনাশকসহ উন্নত কৃষি প্রযুক্তিসহ পর্যাপ্ত শ্রমিক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই ছিলেন। কিন্তু এরপরও কোনও উৎপাদন হয়নি। এতে সংস্থাটির ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।

রংপুরের আলমনগর সবজি বীজ উৎপাদন খামার, নীলফামারীর বীজ উৎপাদন, ঠাকুরগাঁওয়ের বীজ উৎপাদন ও দিনাজপুরের ভিত্তি পাট বীজ উৎপাদন খামারে ২০১৮-১৯ উৎপাদন বছরে যে ব্যয় করা হয়েছে তার চেয়ে আয় অনেক কম দেখানো হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজার টাকারও বেশি।

রংপুরের অ্যাগ্রো সার্ভিস সেন্টারের ২০১৩-১৯ উৎপাদন বর্ষ, নীলফামারীর ডোমরা ভিত্তি আলু বীজ উৎপাদন খামারের ২০১৮-১৯ উৎপাদন বর্ষ, ঠাকুরগাঁওয়ের বীজ উৎপাদন খামারের ২০১৮-১৯ উৎপাদন বর্ষ ও দিনাজপুরের নশিপুর ভিত্তি পাট বীজ উৎপাদন খামারের ২০১৮-১৯ উৎপাদন বর্ষ পযবেক্ষণ করে দেখা গেছে খামারগুলোতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এতে ক্ষতি হয়েছে ৫৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকারও বেশি।

প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, পাবনার টেবুনিয়া বীজ উৎপাদন কেন্দ্রের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নেরিকা (আউশ) উৎপাদনে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৪ হাজার টাকা। কিন্তু আয় হয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। নেরিকা (আমন) উৎপাদনে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫১ হাজার ৪০০ টাকা। আয় হয়েছে ৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। তৈল জাতীয় ফসল উৎপাদনে ব্যয় ছিল প্রায় ৭৯ হাজার টাকা। আয় ৬৭ হাজার। মোট ক্ষতি ৪০ হাজার ৮০০ টাকা ।

টেবুনিয়া ডাল ও তৈল বীজ উৎপাদন খামারে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৯ দশমিক ৫ একর জমিতে ডাল ও তৈল বীজ উৎপাদনে মোট ব্যয় ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৫৩৪ টাকা। ফসল উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ৬১ হাজার টাকার।

বগুড়ার নারুলীতে (উদ্যান) ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মিষ্টি কুমড়া হাইব্রিড উৎপাদনের জন্য ব্যয় হয় ১৫ হাজার ৫৭০ টাকা। আয় ১৩ হাজার ৭২৫ টাকা। ঝিংগা উৎপানে ব্যয় ৬ হাজার টাকা। আয় ৩ হাজার ৭১৫ টাকা। করলায় ব্যয় ১০ হাজার টাকা। আয় ৮ হাজার টাকা।

জানতে চাইলে বিএডিসির চেয়ারম্যান ড. অমিতাভ সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমি বিএডিসির দায়িত্বভার গ্রহণ করি। উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে লোকসান হওয়ার কথা নয়। এটাকে কীভাবে লাভজনক করা যায় বিষয়টিতে নজর দিচ্ছি। অনিয়ম যারাই করবে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। বিষয়টি কঠোরভাবে দেখবো।’