বিএডিসি পর্ব-৬

বিলে স্বাক্ষর দেখিয়েই চার কোটি টাকার বেতন-ভাতা!

নানা অনিয়মে চলছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)এ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ষষ্ঠ পর্ব থাকছে আজ

কৃষি ফার্ম শ্রমিক নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা অমান্য করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হবিগঞ্জের ইটাখোলা বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র এবং বীজ উৎপাদন খামারে শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৬-২০১৭ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় চার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সরকারের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিএডিসি’র বিভিন্ন খামারে কৃষি শ্রমিক নিয়োগের জন্য ২০১৭ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন হয়। সেটার নির্দেশনা অমান্য করে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয় ওই কেন্দ্রে। নিয়োগের সময় শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য তথ্য গ্রহণ করা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে- মূলত ভুয়া শ্রমিক দেখিয়ে অর্থ আত্মসাত করাই ছিল নীতিমালা না মানার উদ্দেশ্য।

ইটাখোলা কেন্দ্রের শ্রমিক মজুরি বিল ও হাজিরা খাতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, কেবলমাত্র একটি বিলে স্বাক্ষর গ্রহণ করেই প্রায় এক কোটি ৩১ লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে। এখানে অর্থগ্রহণকারীদের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি বা অন্য কোনও তথ্য ছিল না।

একইভাবে জেলার বীজ উৎপাদন খামারেও নীতিমালা লঙ্ঘন করে ‘শ্রমিক নিয়োগ’ দেওয়া হয়। এতেও বিলে স্বাক্ষর নিয়ে প্রায় ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে। পাওয়া যায়নি কারও এনআইডির কপি।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালের ৬ জুলাই জারি করা কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা-১ অধিশাখার পরিপত্র ‘কৃষি ফার্ম শ্রমিক নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ২০১৭’ অনুযায়ী অনিয়মিত শ্রমিক (অস্থায়ী/সাময়িক/মৌসুমি) নিয়োগের অন্যতম শর্ত হলো- জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে এবং বার্ষিক কর্মবণ্টন তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অনুমোদন নিতে হবে।

২০১৬ সালের ২৪ মে অর্থ বিভাগের একটি স্মারকে জারি করা দিনভিত্তিক শ্রমিক মজুরি সংক্রান্ত নির্দেশনাও মানা হয়নি এখানে। ওই স্মারকে শর্ত রয়েছে- দৈনিক মজুরির হারে মাসভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না।

এ ক্ষেত্রে অনিয়মিত শ্রমিকদের মাসভিত্তিতে ‘বেতন’ দিয়েছেন সিনিয়র সহকারী পরিচালক (খামার) এবং উপ-পরিচালক (বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র)। এতে মোট অনিয়মিত ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

এ অবস্থায় জাতীয় পরিচয়পত্রসহ শ্রমিকের তালিকা তৈরি করে নিরীক্ষা দফতরে পাঠাতে বলা হয়েছে।

নিয়ম ভেঙে বোনাস!

বিএডিসির বরিশালের লাকুটিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরের ঝুমঝুমপুর বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র এবং সাতক্ষীরার বীজ উৎপাদন ও উন্নয়ন কেন্দ্রের ২০১৭-১৯ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষাকালে শ্রমিক মজুরি, বিল ভাউচার পর্যালোচনা করা হয়।

এতে দেখা যায়, দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের উৎসব ভাতা ও বোনাস দেওয়া হয়েছে। এতে সংস্থাটির মোট ২৯ লাখ ৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।

২০১২ সালের কৃষি মন্ত্রণালয়ের ২২৫ নং স্মারক অনুযায়ী কৃষি ফার্মের নিয়মিত শ্রমিকরা বছরে ২টি এবং অনিয়মিত শ্রমিকরা ১টি উৎসব বোনাস প্রাপ্য হবেন। তবে শর্তানুযায়ী কমপক্ষে ২৪০ দিন একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে হবে।

জানা গেছে, নরসিংদীর বিএডিসির ডাল ও তৈল বীজ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শ্রমিককে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বোনাস বাবদ ৯০ হাজার টাকা এবং ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকাসহ মোট ২ লাখ ২৮ হাজার টাকা বোনাস দেয়।

একইভাবে লাকুটিয়া বীজ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে ২০১৭-১৯ অর্থবছরে ৩ লাখ টাকা, চুয়াডাঙ্গা বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা, ঝুমঝুমপুর কেন্দ্রে ২০১৭-১৯ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৮০ হাজার এবং সাতক্ষীরার বীজ উৎপাদন ও উন্নয়ন কেন্দ্রের ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়।

অর্থমন্ত্রণালয় অর্থবিভাগের ১৯৮৪ সালের পরিপত্র অনুযায়ী সকল সরকারি, করপোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে দিনভিত্তিতে নিয়োজিত কর্মচারী ও শ্রমিকরা উৎসব ভাতা পাবেন না।

এ ছাড়া জেনারেল ফিনান্সিয়াল রুল (জিএফআর)-এর ৪২ নং পরিচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারের আর্থিক ক্ষমতা অন্য কোনও মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষকে অর্পণ করা হলেও তা মূলত অর্থমন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি ছাড়া কোনও ব্যয় মঞ্জুরি আদেশ করতে পারেন না। বিএডিসির নিয়োগকৃত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ নিয়মকানুন পালন করা হয়নি।

বিএডিসির স্থানীয় অফিসগুলো জানিয়েছে, সদর দফতরের নির্দেশনা অনুসরণ করেই শ্রমিকদের উৎসব ভাতা দেওয়া হয়েছে। এতে অনিয়ম হয়নি।

এ অবস্থায় অনিয়িমিতভাবে প্রদত্ত উৎসব ভাতার টাকা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আদায় করে নিরীক্ষা অধিদফতরকে জানাতে বলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএডিসি’র চেয়ারম্যান ড. অমিতাভ সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়গুলোর খোঁজখবর নিচ্ছি। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি। নীতিমালা না মেনে যারা কাজগুলো করেছেন তারাই এর জবাব দেবেন।’