আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বার্ষিক প্রতিবেদন

এ বছর গণপিটুনিতে নিহত ৩৬, ধর্ষণের শিকার ৯৩৬

বিদায়ী ২০০২ সালে গণপিটুনিতে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে আইনশৃ্ঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের, কথিত ক্রসফায়ারে মারা গেছেন চার জন। মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তাদের বাৎসরিক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৯৩৬ নারী।  এছাড়া বছরজুড়ে ২২৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখিন হয়েছেন।

শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আসক কার্যালয়ে ২০২২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে বাৎসরিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আসকের পরিচালক (কর্মসূচি) নিনা গোস্বামী এবং জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির। এছাড়া সম্মেলনটি সভাপতিত্ব করেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন  আসকের নির্বাহী পরিচালম মো. নূর খান।

আসক জানায়, ২০২২ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ২২৬ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৭৯ জন সংবাদকর্মী। দুর্বৃত্তদের গুলিতে কুমিল্লায় নিহত হন এক জন সাংবাদিক। এছাড়াও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক লাঞ্ছিত ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বাধা প্রদানের শিকার হয়েছেন ১৪ জন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বছর এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে।

আসক তথ্যসংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে শুধু র‌্যাবের সঙ্গে কথিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন চার জন। কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় এই ঘটনাগুলো ঘটে।

মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংবাদ সম্মেলন

এছাড়া বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা যান ১৫ জন। এর মধ্যে গ্রেফতারের পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনে চার জন, হার্ট অ্যাটাকে একজন এবং গ্রেফতারের আগে শারীরিক নির্যাতনে চার জন মারা যান। এছাড়া থানা হেফাজত আত্মহত্যা করেছেন দুই জন এবং অসুস্থ হয়ে মারা যান চার জন। থানা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগের পর নানা সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সিসিটিভি ওই সময়ে কার্যকর ছিল না বলে দাবি করে, যা তাদের দায়িত্বশীল আচরণের পরিপন্থি বলেও উল্লেখ করে আসক।

আসক জানায়, এ বছর দেশের কারাগারগুলোর মধ্যে ২১টি কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৬৫ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৮ এবং হাজতি ৩৭ জন। এর মধ্যে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে সর্বাধিক ১৬ জন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৪ জন এবং চট্টগ্রাম কারাগারে ১২ জন মারা যান। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন পাঁচ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে চার জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, পরবর্তীতে ফিরে এসেছেন একজন। আসক জানায়, যখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটকের ঘটনা ঘটছে, তখন পরিবার ও স্বজনদের দাবির মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার বা আটকের কোনও তথ্য না দিয়ে সরাসরি নাকচ করে দিচ্ছে। কিন্তু এরপর বিভিন্ন অভিযোগে উল্লিখিত আটক ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরবর্তীতে গ্রেফতার দেখাচ্ছে।

সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন

২০২২ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ১৬ জনসহ মোট ২৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক লালমনিরহাট জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় সাত জন, কুড়িগ্রাম জেলায় তিন জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় তিন জনসহ দেশের অন্যান্য সীমান্তবর্তী জেলায় আরও ১০ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক ১৫ জন নাগরিক মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

নারী নির্যাতন

আসক জানায়, ২০২২ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৯৩৬ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাত জন। ধর্ষণের ঘটনা সর্বাধিক ৮৮ টি ঘটেছে ঢাকা জেলায়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে ৮৩টি, চট্টগ্রামে ৫২টি, গাজীপুরে ৪৯টিসহ বাকি সব জেলাতেই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন মোট ১৩২১ নারী।

এছাড়া এবছর যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২৪৭ জন নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ৭৮ জন পুরুষ। এ বছর উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন সাত নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আট জন পুরুষ খুন হয়েছেন।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৭৯ নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ২৯২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯৭ জন। ২০২১ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৬৪০ জন নারী। অন্যদিকে ২০২২ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৭৪ নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৭৯ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেন সাত নারী।

আসকের তথ্য মতে, ২০২২ সালে সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ৬ নারী নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে সালিশে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন পাঁচ নারী, নির্যাতন পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করেন এক নারী। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে সালিশ ও ফতোয়ার শিকার হয়েছিলেন মোট ১২ নারী।

এছাড়া এবছর ২৬ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পরবর্তী সময়ে মারা যান ১২ জন নারী। অন্যদিকে এ বছরে অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১৩ জন নারী।

শিশু অধিকার

বিদায়ী বছরে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৫১৬ জন শিশু। নিহতদের মধ্যে ঢাকা জেলায় সর্বাধিক ৬৪, গাজীপুরে ৩৬ এবং নারায়ণগঞ্জে ৩৩ শিশু নিহত হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে নিহত শিশুর সংখ্যা ছিল ৫৯৬ জন। এছাড়া ২০২২ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ১০৮৮ জন শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ৫৬০ জন শিশু, ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ১০০ জন শিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৫২ ছেলে শিশু। বিভিন্ন মাদ্রাসায় ছেলে শিশু বলাৎকারের অভিযোগ ছিল উদ্বেগজনক; উল্লেখ্য, এ বছরে বলাৎকারের শিকার ৫২ ছেলে শিশুর মধ্যে কমপক্ষে ৩৪ জন ছেলে শিশু বিভিন্ন মাদ্রাসায় বলাৎকারের শিকার হয়েছে।