স্বজনপ্রীতির অভিযোগ

বিজয় সরণিতে ট্রাফিকের নতুন উদ্যোগ কতটা কার্যকর?

গত বছরের অক্টোবর মাসে ঢাকার ব্যস্ত সড়কে যানজট নিরসনে পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। মানিক মিয়া এভিনিউ ও তেজগাঁও লাভ রোডে চতুর্মুখী রাস্তায় ডাইভারশন করে একমুখী গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরীক্ষামূলক এই পদক্ষেপে ‘আশাতীত’ ফল পাওয়ার কথা বলছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। এরই ধারাবাহিকতায় গত শনিবার (২৫ জানুয়ারি) থেকে বিজয় সরণি মোড়ে যানজট নিরসনে ডাইভারশন চালু করা হয়েছে। গত ২৩ জানুয়ারি ডিএমপি কমিশনার এক গণবিজ্ঞপ্তিতে নতুন উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন।

ট্রাফিক বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন নিয়ম অনুযায়ী জাহাঙ্গীর গেট থেকে বিজয় সরণিতে আসা যানবাহনগুলোকে ডানে মোড় নিতে দেওয়া হচ্ছে না। ডান দিকে অর্থাৎ মোহাম্মদপুর বা ধানমন্ডির দিকে যাওয়া গাড়িগুলো প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে দিয়ে নতুন রাস্তা হয়ে যাবে কিংবা কাওরান বাজার সোনারগাঁও সিগন্যাল দিয়ে যাবে। এতে করে বিজয় সরণির সিগন্যালে যানবাহনের চাপ কমবে এবং জ্যাম কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

472755096_9021216504623966_7665824707588862318_nতবে চালক ও যাত্রীরা বলছেন, হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত এবং রশি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় সহজে গন্তব্যে যেতে না পেরে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে চালক ও যাত্রীদের। একইভাবে ডিএমপির নতুন নিয়ম না জানা যানবাহনের চালকদের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এছাড়াও এক কিলোমিটারের রাস্তা কয়েক কিলোমিটার ঘুরে যেতে হচ্ছে।

অন্যদিকে বিজয় সরণি সিগন্যালে নতুন নিয়মে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় স্বজনপ্রীতি অভিযোগও রয়েছে। চালক ও যাত্রীরা বলছেন, জাহাঙ্গীর গেট থেকে আসা সাধারণ যানবাহনগুলোকে ডানে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে ভিআইপি গাড়ি, সামরিক যানবাহন, এমনকি ফ্ল্যাগ লাগানো আমলাদের গাড়িগুলো রশি উঁচু করে ডানে বা ইউটার্ন নিতে দিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা।

বিজয় সরণিতে ট্রাফিক বিভাগের নতুন উদ্যোগ চালুর পর শনিবার ও রবিবার সরেজমিনে এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। দেখা যায়, বিজয় সরণি মোড় হয়ে চলাচল করা অন্য সব সড়কের যানবাহন স্বাভাবিকভাবেই চলাচল করছে। তবে জাহাঙ্গীর গেট থেকে বিজয় সরণি আসা যানবাহনগুলোকে সিগন্যাল ছাড়ার পরপরই রাস্তার মাঝে টানিয়ে দেওয়া হচ্ছে রশি। যাতে কোনও যানবাহন ডানে যেতে না পারে। তবে সামরিক বাহিনীর যানবাহন এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার গাড়ি ‌এলে রশি উঁচু করে ডানে যেতে দেওয়া হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের এমন দ্বৈতনীতি দেখে ক্ষুব্ধ সাধারণ যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা।

রবিবার দুপুরে দেখা যায়, জাহাঙ্গীর গেট থেকে বিজয় সরণি সিগন্যালে আসা কয়েকটি সরকারি গাড়ি ছেড়ে দেওয়ায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তর্কে জড়াচ্ছেন সাধারণ যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। এ সময় সাধারণ চালক ও যাত্রীদের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে উত্তেজিত হতেও দেখা গেছে।

ফাহিমুর রহমান নামে প্রাইভেটকার চালক বলেন, এমন দ্বৈতনীতি থাকলে মানুষ কেন আইন মানবে। কেন ট্রাফিক পুলিশের কথা শুনবে। আমার সামনে একটি সরকারি গাড়ির জন্য প্রতিবন্ধকতা দেওয়া রশি উঁচু করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমি সেই গাড়ির পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া চেষ্টা করলে আমাকে আটকে দেওয়া হয়। আমাকে ডানে যেতে দেওয়া হয়নি।

সুমন পাটোয়ারী নামে এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, রাস্তার যানজট কমাতে ট্রাফিক পুলিশ নানা ধরণের উদ্যোগ নিতে পারে। তবে এ ধরণের উদ্যোগ কার্যকর করার অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রচার-প্রচারণার দরকার ছিল। মহাখালী বা জাহাঙ্গীর গেট থেকে ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাধারণ মানুষকে অবহিত করার প্রয়োজন ছিল। এছাড়াও আইন সবার জন্য সমান হবে। সরকারি গাড়ির জন্য এক ধরণের আইন থাকবে, আর সাধারণ মানুষের জন্য আরেক ধরণের আইন থাকবে, এটা হতে পারে না।

474981352_1286920825674679_1349027535835804122_nট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দ্বৈতনীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে কেন— এ সম্পর্কে জানতে চাইলে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. মোর্তজা মোশারফ বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে আমাদের যেভাবে দিক-নির্দেশনা দেওয়া আছে, আমরা সেভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। আমাদের বলা আছে, জরুরি প্রয়োজনে যানবাহনগুলোকে ছেড়ে দিতে হবে। সামরিক বাহিনীর যানবাহনগুলো জরুরি যানবাহন হিসাবে ছেড়ে দেওয়া জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে।

বিজয় সরণি ট্রাফিক সিগন্যালের দায়িত্বরত ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) সুজা চৌধুরী বলেন, এটা ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারবো না। আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে, আমরা সেভাবে কাজ করছি। 

কতটা কার্যকর হচ্ছে বিজয় সরণির নতুন উদ্যোগ

শনিবার (২৫ জানুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া নতুন এই নিয়ম যারা জানেন, তারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনের ক্রসিং দিয়ে আগারগাঁও লিংক রোডে চলে যাচ্ছেন। তবে মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, খেজুর বাগান, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ অভিমুখী যানবাহনের যেসব চালক এই নিয়ম জানেন না তাদের পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। সিগন্যালে আটকে থেকে যখনই তারা ডানে মোড় নিতে যাচ্ছেন, তখনই পড়ছেন প্রতিবন্ধকতার মুখে। গাড়ি ধীর করে অনেকেই ডানে যাওয়ার জন্য ট্রাফিক পুলিশের কাছে আকুতি-মিনতি করছেন। কেউ কেউ আবার কেন যেতে দেওয়া হচ্ছে না সেই কৈফিয়ত চাচ্ছেন দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কাছে। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডায়ও জড়াচ্ছেন কেউ কেউ।

যানবাহন চালকরা বলছেন, বিজয় সরণিতে ডানে যেতে না দেওয়ার নতুন এই উদ্যোগটি হঠকারী সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোনও ধরনের সিগন্যাল, সাইন না দিয়ে হঠাৎ রাস্তা বন্ধ করে দিলে তাদের গন্তব্যে যেতে দীর্ঘ পথ ঘুরতে হচ্ছে। এতে সময় ও জ্বালানি বেশি নষ্ট হচ্ছে।

তবে ট্রাফিক পুলিশ বলছে, নতুন কোনও অভ্যাসে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। নতুন এই উদ্যোগের সুফল দ্রুতই নগরবাসী পাবে। শুরুতে কিছুটা সমস্যা তৈরি হলেও দ্রুতই তা ঠিক হয়ে যাবে।

বনানী থেকে ধানমন্ডি যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন ফয়সাল নামে এক রাইড শেয়ারকারী। তিনি প্রায় ১০ মিনিট বিজয় সরণি সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সিগন্যাল যখন ছেড়েছে, তখনই রাস্তার মাঝে রশি টানিয়ে দেওয়া হয়। এতে তিনি আর ডানে যেতে পারেননি। কেন যেতে দেওয়া হচ্ছে না সেই প্রশ্নও তিনি ট্রাফিক পুলিশকে করেছেন। ট্রাফিক পুলিশও যেতে না দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। ফয়সাল বলেন, আমি আগে থেকে এ সম্পর্কে জানতাম না। প্রায় ১০ মিনিট ধরে এই সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছি। এখন আমাকে যেতে হলে আবার কারওয়ান বাজার ঘুরে আসতে হবে। এটা আমাদের জন্য ভোগান্তি।

আলীম হাওলাদার নামে এক সিএনজিচালক বলেন, এটা একটা বিবেকহীন ও হঠকারী সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে যানজট তো কমবেই না বরং আরও বাড়বে। আর আমাদের কষ্ট হবে।

তবে, সিগন্যালে গাড়ি আটকে না থেকে রানিং থাকলে যানজট কিছুটা কমতে পারে বলেও মনে করছে অনেক চালক ও যাত্রী।

সবুজ সরকার নামে এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, একটি সিগন্যালে আমাদের প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট জ্যামে বসে থাকতে হয়। যদি সব সময় সিগন্যাল এবং রাস্তায় গাড়িগুলো রানিং থাকে তাহলে যানজট কিছুটা কমতে পারে।

সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুরে বিজয় সরণি সিগন্যালে দেখা যায়, সিগন্যাল চলছে আগের নিয়মে। জাহাঙ্গীর গেট থেকে আসা যানবাহনগুলোকে কোনও ধরণের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ডানে মোড় নিতে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে গত দুইদিন রশি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সিগন্যাল ছাড়ার পর স্বাভাবিক নিয়মে গাড়িগুলোতে ডানে ইউটার্ন নিতে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) তানিয়া সুলতানা বলেন, যানজট রাজধানীর অন্যতম প্রধান সমস্যা। যানজট নিরসনে ব্যস্ততম সিগন্যাল বিজয় সরণিতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে কিছুটা সময় লাগবে। এখনও সবাই অভ্যস্ত হতে পারেনি। যার জন্য অনেক চালক ও যাত্রীদের কিছুটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। যার ফলে আমরা কখনও কখনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে ডানে মোড় নিতে দিচ্ছি। হঠাৎ করে সবাইকে জোর ধরে নতুন কোনও নিয়ম মানানো যাবে না। তবে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন এই নিয়মের সঙ্গে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তখন এর সুফল নগরবাসী পাবে।