সাক্ষাৎকারে আহমাদ মোস্তফা কামাল

‘লেখকদের জন্য কোনও সময়ই অনুকূল ছিল না’

আহমাদ মোস্তফা কামাল। লেখক, সাহিত্যিক এবং বাংলাদেশে ব্লগের শুরুর সময়ের একজন সচেতন ব্লগার। লিখছেন ২৫ বছর ধরে। ১৯৯০ সালে যখন তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির পদার্থ বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় লেখার আগ্রহ জন্মায়। একাডেমিক পরিসরে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি স্কলারশিপ নিয়ে ইতালি যান কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ফিরেও আসেন। সমসাময়িক সমাজ, আন্দোলন ও ভাবনার পথকে স্পষ্ট করে এমন চিন্তা করেন, চিন্তা এগিয়ে নেওয়ার কাজটাও করেন একইসঙ্গে। একসময় ব্লগ ছেড়েছেন তবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন আরও কিছু সময় গেলে ব্লগ আরও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবেন। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আঠারোটি। পেয়েছেন প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার ২০০৭, এইচএসবিসি-কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার ২০০৯ এবং জেমকন সাহিত্য পুরস্কার ২০১২। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। লিখছেন বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায়।বাংলাদেশে ব্লগ, ব্লগার পরিচিতি এবং তারপর বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় ব্লগাররা ঝুঁকির মধ্যেও নিজেদের অবস্থান জানান দিতে যে লড়াই করছেন সেসব নিয়েই বাংলা ট্রিবিউনের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে লেখক, সাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল।

 

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশে ব্লগিংয়ের শুরুর দিকে এর লক্ষ্য কেমন ছিল?

আহমাদ মোস্তফা কামাল: বিষয়টি নিয়ে আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন ব্লগের উদ্যোক্তারা। আমি ব্লগে লিখতে শুরু করি ২০০৮ সালে। বছর দেড়েক পর ছেড়েও দিই। তার আগে দেড় যুগ ধরে প্রিন্ট মিডিয়ায় লিখেছি। ব্লগ ছাড়ার পর সেভাবে আর ফেরা হয়নি। তবে ওই সময়টি যেহেতু ব্লগের প্রারম্ভিককাল ছিল এবং যেহেতু দুই ধরনের মিডিয়ায় লেখারই অভিজ্ঞতা আমার আছে, একটা তুলনামূলক বিচার করতে পারি। আমার কাছে মনে হয়েছিল, চিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্লগ অনেক স্বাধীন মাধ্যম এবং বিষয়-বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে অনেক এগিয়ে। নানা বিষয়ে নানা ধরনের লেখা দেখেছি ব্লগে, এবং সেগুলো দ্বিধাহীনভাবেই প্রকাশ করতেন ব্লগাররা। এই অর্থে আমি বলবো- স্বাধীন ও উন্মুক্ত চিন্তা প্রকাশের একটা মাধ্যম তৈরি করাই ব্লগিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল।

প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে ব্লগ অনেক এগিয়ে

বাংলা ট্রিবিউন: ব্লগগুলো খেয়াল করলে লেখালেখির ক্ষেত্রে কখনও নারীর প্রতি অসংবেদনশীলতা এবং সমালোচনা গ্রহণে অসহিষ্ণুতা দেখা যায়। এই ধরনটার সঙ্গে আপনি একমত কিনা। মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতার যে সংস্কৃতি, শ্রদ্ধার যে সামাজিক রীতি আমাদের ছিল; এ ধরনের লেখালেখির মাধ্যমে সেটা কি ভেঙে গেছে?

আহমাদ মোস্তফা কামাল: লেখালেখি ব্যাপারটা কিন্তু সংবেদনশীল মানুষের জন্যই। যিনি এমন নন তার পক্ষে লেখালেখি করা সম্ভবই নয়। যে তরুণটি নারীর প্রতি অসংবেদনশীলতা দেখাচ্ছেন, সমালোচনা নেওয়ার ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছেন তার পক্ষে লেখক হওয়া সম্ভবই নয়। সত্যি কথা বলতে কি, লেখালেখি যে একটা দায়িত্বের ব্যাপার সেটা বুঝতে অনেকেরই সময় লাগে। আর বোঝার আগেই যদি কেউ একটা উন্মুক্ত জায়গা পেয়ে যান যেখানে যা ইচ্ছা বলা যায় যেমন ব্লগ বা ফেসবুক, তাহলে এই ধরনের অসহিষ্ণুতা  এবং অসংবেদনশীলতার সমস্যাগুলো তৈরি হয়। প্রিন্ট মিডিয়ায় লেখার ক্ষেত্রে একজন লেখক অশ্লীল কথা লিখলে সম্পাদক তা কেটে দেবেন। কিন্তু ব্লগ-ফেসবুকে কোনও সম্পাদক নেই, নিজেকেই নিজের সম্পাদক হিসেবে তৈরি করে নিতে হয়। এরকম উন্মুক্ত মাধ্যমে একজন তরুণ যখন লেখালেখি করেন তখন তিনি যা খুশি তা-ই লিখতে চান। এটা তো ঠিক কাজ নয়। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকলে যেকোনও জায়গাতেই সেটা দেখানো যায়। আর যার এ বোধ নেই সে কোথাও সেটা দেখাবে না। নেতিবাচক আচরণগুলো শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিমানুষের চরিত্রের চিহ্নই রেখে যায়। এমনকি ছদ্মনাম ব্যবহার করলেও চিহ্নটি রয়ে যায়। অনেকেই হয়তে ভাবেন, আমাকে কেউ চিনবে না, কিন্তু আমার পেছনেতো আমিই দাঁড়িয়ে আছি, সেই দায়িত্বশীলতাটুকুতো থাকতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে তরুণরা চিন্তা করেন না তেমন একটা। চিন্তা করার মতো বয়সও অনেকের হয়নি, সময় দিতে হবে।

 
বাংলা ট্রিবিউন: যখন আমরা বড় হচ্ছি, তখন আমাদের যারা বড় আছেন তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে আগ্রহের জায়গাগুলো তৈরি করা, সমসাময়িক বিষয়গুলো বোঝা, তাদের আড্ডায় পেছনের দিকে বসে বিষয়গুলো ধরার চেষ্টার আবহ ছিল। এখন সেই সামনাসামনি যোগাযোগটা আর নেই।আচরণগত পার্থক্যের এটাও কি একটা কারণ?

 লেখালেখি যে একটা দায়িত্বের ব্যাপার সেটা বুঝতে অনেকেরই সময় লাগে

আহমাদ মোস্তফা কামাল: অবশ্যই, এবং জটিল সামাজিক সমস্যা। খেয়াল করে দেখবেন, বাস্তবে যে ব্যক্তি আপনার সঙ্গে যেভাবে কথা বলে, ভার্চুয়ালি বলতে গেলে তখন তার টোন বদলে যায়। সে সেখানে বিরক্ত প্রকাশ করতে চাইলে নির্দ্বিধায় করে ফেলে, গালি দিতেও দ্বিধা করে না। বাস্তব জীবনে সে হয়তো এমন না। সেই ওরিয়েন্টেশনটা দরকার। আমি বরাবরই ব্লগ বিষয়ে পজেটিভ ধারণা রাখি। তারপরও আমি ব্লগ ছেড়ে এসেছি। কারণ অসম্মানটা আমি নিতে পারি না। কেউ একজন আমার সঙ্গে বিতর্ক করতে পারে, কিন্তু গালি দিতে পারে না, কারণ আমি তাকে গালি দিচ্ছি না।

 

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কি মনে হয়, ২০১৩ সালের হেফাজতের উত্থানের মধ্য দিয়ে ব্লগারের যে ভিন্ন মানে দাঁড়িয়েছে সেটা তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে?

আহমাদ মোস্তফা কামাল : হেফাজতের উত্থানের মধ্য দিয়ে নয়, শাহবাগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্লগ ও ব্লগারের একটা ভিন্ন মানে দাঁড়িয়েছে। ব্লগাররা যতদিন পর্যন্ত ভার্চুয়াল ছিলেন, যতদিন পর্যন্ত কি-বোর্ড, ইন্টারনেট, ব্লগ, ফেসবুক ইত্যাদির মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, তখন ব্লগ বা ব্লগার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু যখন তারা ভার্চুয়াল জগৎ ছেড়ে নিজেদের বাস্তব পরিচয় নিয়ে রাজপথে নামলেন, প্রতিবাদে মুখর হলেন, তখনই তাদের ওপর সবার দৃষ্টি পড়লো। বলাইবাহুল্য, তাদের এই প্রতিবাদ এতটাই তীব্র ও কার্যকরী ছিল যে, রাষ্ট্রের ভেতরে ক্রিয়াশীল নানা দল ও গোষ্ঠী তাদের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য হলো। শুরু হলো নোংরা রাজনীতি। হেফাজতের উত্থান তেমনই এক রাজনৈতিক চাল বলে মনে হয়েছিল আমার।

 

বাংলা ট্রিবিউন: কিন্তু পরে সমাজের প্রতি ব্লগারের যে দায়িত্ব সেটা ঝুলে গেল কেন? আর ব্লগে যে তর্ক বিতর্কগুলো হয় সেগুলোর কিছু অংশ বাদ দিলে পুরোটাই গঠনমূলক মনে হয় না কেন? ২০১৩ পরবর্তীতে ‘আমি ব্লগার’ বলা যেমন বেড়ে গিয়েছিল, ২০১৪ থেকে ‘আমি ব্লগ করি না’ বলার প্রবণতা বাড়লো। এর দায় কি রাষ্ট্রের, যে ব্লগারদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি?

আহমাদ মোস্তফা কামাল: আগে প্রশ্ন করা দরকার, ব্লগারদের কাছ থেকে আমরা বেশি আশা করছি কিনা। ২০১৩ সালের আন্দোলনে ব্লগাররা সম্পৃক্ত না হলে তাদের কাছ থেকে আপনি কী আশা করতেন? যারা ব্লগ শুরু করেছিল তাদের লেখার বয়স হয়েছে মাত্র ১০বছর। আমি লেখালেখি করছি ২৫ বছর। এখন তাদের ওপর এত দায় চাপানো ঠিক হবে কিনা সেটাও ভাবতে হবে। ওদের যতটুকু সামর্থ তার চেয়ে ওরা বেশি করেছে। এখন তাদের খুন করে ফেলা হচ্ছে। তারপরও তারা চেষ্টা করছে কিছু বলতে, কিছু করতে। তারা অত বড় দায়িত্ব পালনের জায়গায় আসেনি, সময় দিতে হবে।

সহযাত্রী লেখক-ব্লগাররা খুন হয়ে গেলে হতবিহ্বল-বিমূঢ় দশা পার হতেই তো দীর্ঘ সময় লেগে যায়! ভয়-আতঙ্ক যে ঘিরে ধরে না, তাও তো নয়।

বাংলা ট্রিবিউন: একের পর এক ব্লগার হত্যার পর প্রতিরোধের লেখাও কি আদৌ দেখা গেছে? যদি না দেখা গিয়ে থাকে সেটা কেন?

আহমাদ মোস্তফা কামাল : প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যে হয়নি তা নয়, তবে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে দেখা যায়নি। কেন যায়নি বলা মুশকিল। ব্লগাররা তো কোনও যুদ্ধাংদেহী বিপ্লবী নন, সাধারণ লেখক মাত্র। খুনখারাবির মতো ভয়াবহ সব বিষয়ের বিরুদ্ধে মূল ধারার লেখকরা যেমন কোনও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অক্ষম, ব্লগাররাও তাই। সহযাত্রী লেখক-ব্লগাররা খুন হয়ে গেলে হতবিহ্বল-বিমূঢ় দশা পার হতেই তো দীর্ঘ সময় লেগে যায়! ভয়-আতঙ্ক যে ঘিরে ধরে না, তাও তো নয়।

 

বাংলা ট্রিবিউন: এখন সবাই কমবেশি সেলফ সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটা সামগ্রিকভাবে কী ক্ষতি করছে বলে মনে করেন?

আহমাদ মোস্তফা কামাল: সেলফ সেন্সরশিপের ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী। যদি সাময়িক কৌশলের অংশ হিসেবে, নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য কেউ সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করেন, তাহলে কিছু বলার নেই। কিন্তু এটা যদি অভ্যাসের অংশ হয়ে যায় তাহলে একসময় স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে অক্ষম হবেন তিনি, পরিবেশ যতই অনুকূল হোক না কেন। তাছাড়া, লেখকদের জন্য কোনও সময়ই অনুকূল ছিল না। ইতিহাসের আদিকাল থেকে মুক্তচিন্তা-স্বাধীনচিন্তা-নতুনচিন্তা প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের নানা প্রতিষ্ঠান। সেসব বাধা অতিক্রম করেই লেখককে লিখে যেতে হয়। সেলফ সেন্সরশিপের এই ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়াই লেখকের জন্য স্বাস্থ্যকর বলে মনে করি।

 

বাংলা ট্রিবিউন: আগামীতে শক্তিশালী একটা সমাজের জন্য ব্লগারদের ভূমিকা কী হতে পারে?

আহমাদ মোস্তফা কামাল: আমি ব্যক্তিগতভাবে কারও ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে নই। ব্লগারদের কাজ হচ্ছে লেখা, স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করা। সুন্দর ও কল্যাণের পক্ষে, মঙ্গল ও প্রগতির পক্ষে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে, সাম্য ও অধিকারের পক্ষে যে লেখাগুলো তারা লিখে চলেছেন সেগুলোর কোনও তাৎক্ষণিক প্রভাব দৃশ্যমান না হলেও এর দীর্ঘস্থায়ী মূল্য অনেক। লেখালেখি তাৎক্ষণিকভাবে সমাজ পরিবর্তন করতে পারে না, বিপ্লব করতে পারে না, সমাজ গড়তেও পারে না। তবে পাঠকদের মনের গড়ন তৈরি করে দিতে পারে। পাঠকদের মন দীর্ঘসময় ধরে তৈরি হয়, সংবেদনশীল হয়, আর তারাই একদিন একটি সংবেদনশীল ঋদ্ধ সমাজ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্লগারদের ইতিবাচক লেখাগুলোও একদিন পাঠকদের কাছে সেভাবে গৃহীত হবে বলে বিশ্বাস করি।

 

 

/এফএ/