জাবালে নুর: যে পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়েছিল আলোর ঝরনাধারা

সকাল সাতটার দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে আমি আর আমার সহধর্মিণী সামনের রাস্তায় চলে এলাম। আজকের গন্তব্য মক্কা শহরতলিতে জাবালে নুর, হেরা গুহা। নবীজি (সা.) সমীপে প্রথম কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল যে গুহায়।

আমাদের হোটেল ইবরাহিম খলিল রোডে। এটাকে মিসফালা রোডও বলে। মিসফালা শব্দের অর্থ সেতু/ব্রিজ। ইবরাহিম খলিল রোডের ওপর দিয়ে একটি ফ্লাইওভার চলে গেছে। এই ফ্লাইওভার বা উড়ালসেতুর জন্য অনেকে এটাকে মিসফালা রোড বলে ডাকে।

ইবরাহিম খলিল রাস্তার পাশে সবই বড় বড় হোটেল। কাবা চত্বরের পাশে বিখ্যাত জমজম ক্লক টাওয়ারের পাশ থেকেই শুরু হয়েছে এই রাস্তা। প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রাস্তা শেষ হয়েছে মিসফালা মূল রাস্তার সঙ্গে। ইবরাহিম খলিল রাস্তার একপাশে একসময় একটি বড় পাথুরে পাহাড় ছিল, এখন সেটি কেটে ছোট করা হচ্ছে। কিছু দিন পর হয়তো এখানে বিশালাকার সব হোটেল গড়ে উঠবে। রাস্তার আরেক পাশের পুরোটা আবাসিক হোটেলের জগদ্দল। শুরুতে পাঁচ তারকা মানের দামি হোটেল। একটু পর থেকে কম দামি পাকিস্তানি আর বাঙালি হোটেল।

এ এলাকার পুরোটাতে পাকিস্তানি আর বাঙালিদের রাজত্ব। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মনোহারি দোকান, গিফট শপ—সর্বত্র বাঙালি পাবেন, বিশেষত চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ। কোনও দোকানের সামনে দিয়ে গেলে চেহারা দেখে আপনাকে বাঙালি ভেবে ডেকে উঠবে—‘দেশি আসেন, দেখি যান...!’

রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালে ট্যাক্সির অভাব নেই। আমরা দুজন ট্যাক্সির ড্রাইভারদের পরখ করছিলাম। বেশিরভাগ ট্যাক্সি ড্রাইভার পাকিস্তানি নয়তো বাঙালি, অ্যারাবিয়ানও আছে। আমরা বাঙালি ড্রাইভার খুঁজছি। মধ্যবয়সী হুজুরের মতো দেখতে এক ড্রাইভার দেখে এগিয়ে গেলাম, বাঙালি। ২০ রিয়ালে রফা হলো তার সঙ্গে। আমাদের জাবালে নুরে নামিয়ে দিয়ে আসবে।

ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলাম। যেহেতু বাঙালি, কথাবার্তা বললে তাদের থেকে অনেক অভিজ্ঞতা জানা যায়। সত্যি সত্যি এক অবাক করা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম ড্রাইভারের পরিচয় জেনে।

তার নাম ইয়াহইয়া। ৪৮ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন। তিনি কথা বলেন বাংলায়, তবে তিনি বাঙালি নন, আরাকানি। মানে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ। তার বয়স যখন ৫ বছর তখন মা-বাবার সঙ্গে এখানে চলে এসেছেন। বিয়ে-শাদি এখানেই, এখানেই ঘরবাড়ি করেছেন। যদিও তিনি সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পাননি।

‘তাহলে আপনার জাতীয়তা কী?’ জিজ্ঞেস করলাম ইয়াহইয়া ভাইকে।

‘পাকিস্তানি, আমার পাসপোর্টও পাকিস্তানি। আমার মা-বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলে এখানে এসেছিলেন। তখন পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়েই এসেছিলেন। সে হিসেবে আমারও পাকিস্তানি হিসেবে এখানে আসা। আরাকানের তো আর নিজস্ব পাসপোর্ট নেই। আর আমি তো বাঙালিও না।’ ইয়াহইয়া ভাই সহজ সরল উত্তর দিলেন।

তার কথা শুনে আমি কিছুটা আহত হলাম। তাহলে তার দেশ কোনটা? পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার নাকি সৌদি আরব? তিনি নৃতাত্ত্বিকভাবে বার্মিজ-আরাকানি, জাতীয়তা পরিচয়ে পাকিস্তানি, বেড়ে উঠেছেন বাঙালি সংস্কৃতিতে, বসবাস করছেন সৌদি আরবে। তার মাতৃভূমির পরিচয় তবে কী? তিনি কি তবে মাতৃভূমিহীন একজন মানুষ? আশ্চর্য প্রশ্ন!

কথা বলতে বলতে মিনিট বিশেকের মধ্যে আমরা জাবালে নুরের পাদদেশে চলে এলাম। মক্কার শহরতলির এই জায়গাটা দরিদ্র পাকিস্তানি অধ্যুষিত। ঘরবাড়িগুলো পাকিস্তানি আদলে বানানো। রাস্তায় পাকিস্তানি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনাগোনা।

ছবিতে জাবালে নুর বলতে আমরা যেটা দেখি, বাস্তবে এটা তার চেয়ে অনেক উঁচু। সমতল থেকে প্রায় ২২০০ ফুট বা সাড়ে ছয়শ মিটার উচ্চতা। আধা কিলোমিটারের চেয়েও বেশি। নিচ থেকে দেখতে যতটা নিরীহ লাগে, আদতে এটা বেয়ে ওঠা বেশ কঠিন। নিচ থেকে প্রায় খাড়া হয়ে উঠেছে পাথুরে পাহাড়। পাথর কেটে ছোট ছোট সিঁড়ি বানানো হয়েছে। সেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। এই পাথুরে পর্বতের একদম চূড়ায় হেরা গুহা।

আমরা উঠতে শুরু করলাম। পর্বত আরোহণের ব্যাপারে ড্রাইভার ইয়াহইয়া ভাই আমাদের একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছিলেন—ধীরে ধীরে জিরিয়ে জিরিয়ে উঠবেন। তাড়াহুড়ো করতে গেলে হাঁপিয়ে যাবেন, শ্বাস নিতে কষ্ট হবে, তখন আর উপরে উঠতে পারবেন না।

আমরা ইয়াহইয়া ভাইয়ের বুদ্ধি অনুসরণ করে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম। একটু পর পর জিরিয়ে নেবার মতো জায়গা বানানো আছে, সেখানে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। সঙ্গে পানির বোতল ছিল, দু-এক ঢোক পানি দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম। রোদের তেজ বাড়ছে হু হু করে, কিছুক্ষণের মধ্যে তপ্ততা আরও বেড়ে যাবে। একে তো সূর্যের তাপ, আবার পাথরও গরম হয়ে উঠবে। ভাগ্য ভালো সকাল সকাল এসেছি। নইলে গরমে তেষ্টানো যেত না। আরও সৌভাগ্য, প্রচুর বাতাস রয়েছে। বাতাসে তবু গরম ততটা গায়ে লাগছে না। তবে উঠতে উঠতে ভাবলাম, জাবালে নুরে উঠতে হলে অবশ্যই ফজরের পর পর চলে আসতে হবে। সকাল আটটা নয়টার পরে তো ভুলেও এমুখো হওয়া যাবে না। এই গরমে সম্ভবই না উপরে ওঠা।

পথ যেন আর ফুরায় না। এমন খাড়া পাথর মাড়িয়ে পাহাড়ে ওঠা হয়নি জীবনে। মাঝে মাঝে চোখে সর্ষেফুল দেখছি। পা ইতোমধ্যে ব্যথা করতে শুরু করেছে। উচ্চতার জন্য অক্সিজেনেরও যেন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবু তাড়াহুড়ো করছি না।

আমাদের আগে-পরে আরও অনেকে যাত্রা শুরু করেছিল। মনে করেছিল, এ আর এমন কি! কিন্তু কিছু দূর ওঠার পরই তাদের হতোদ্যম হয়ে বসে পড়তে দেখলাম। এক মাওলানা সাহেবকে দেখলাম দুই-তিন জন খাদেম পরিবেষ্টিত হয়ে আমাদের পেছন পেছন যাত্রা শুরু করেছেন। আমরা কিছু দূর ওঠার পর পেছনে তাকে আর দেখতে পেলাম না। হতোদ্যম হয়ে হয়তো যাত্রাভঙ্গ করেছেন।

একদম চূড়ায় উঠতে প্রায় এক ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় লাগলো। চূড়ায় পৌঁছে জিরিয়ে নিলাম খানিকক্ষণ। বসার বন্দোবস্ত আছে। পাকিস্তানি দু-একটা দোকানও আছে হালকা খাবার আর পানীয়র। সেসব ছাপিয়ে আমি ভাবছি, নবীজি (সা.) এতটা পথ বেয়ে কীভাবে কয়েক দিন পর পর এই চূড়ায় পৌঁছতেন? লোকালয় থেকে এতটা দূরে এই নির্জন পর্বতচূড়ায় একা একা ভয় করতো না তার? নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে কয়েক দিনের খাবার নিয়ে এসে এখানে তিনি একাগ্রচিত্তে ধ্যান করতেন। শুধু হাওয়ার ফিসফিসানি ছাড়া এখানে আর কোনও শব্দ নেই। কতটা নিবেদিত ছিলেন তিনি!

‘হেরা গুহা’ পাহাড়চূড়ার পাশে অবস্থিত। সেখানে ইতোমধ্যে প্রচুর মানুষ ভিড় করেছেন। গুহার ভেতরে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ার লাইন ধরেছে সবাই। মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখে আমি আর আমার সহধর্মিণী ওমুখো হলাম না। ওই লাইন শেষ হতে হতে জোহরের নামাজের সময় হয়ে যাবে। দরকার নেই। এখানে নফল নামাজ পড়ার বিশেষ কোনও ফজিলত নেই ‍যদিও, মানুষ আবেগের বশবর্তী হয়ে নামাজ পড়ছে। তাতে দোষেরও কিছু নেই। অবশ্য এই পর্বতে ওঠার ব্যাপারেও কোনও ফজিলত নেই। আমরা শুধু নবীজির স্মৃতিধন্য পাহাড় আর গুহাটি দেখতে এসেছি। যে গুহায় ধ্বনিত হয়েছিল ইসলামের প্রথম মর্মবাণী ‘ইকরা’! আল-কোরআনের প্রথম পাঁচটি আয়াত ফেরেশতা জিবরাইলের মাধ্যমে উচ্চারিত হয়েছিল নবীজির (সা.) মুখে—

‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন

সৃষ্টি করেছেন মানুষকে বীর্যবিন্দু থেকে

পড়ো, আর তোমার প্রভু নিয়ত দয়াশীল

যিনি জ্ঞান দিয়েছেন কলমের মাধ্যমে

মানুষকে সেসব জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জানতো না।’

এই পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে নবীজিকে (সা.) এ পৃথিবীর শেষ নবী ও রাসুল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই নুর পর্বতের চূড়ায় সেদিন ঘোষিত সেই পাঁচটি আয়াত পরবর্তীতে বদলে দিয়েছিল সমগ্র পৃথিবীর গতিপথ। অভিনব এবং অবিনশ্বর এক ধর্মের গোড়াপত্তনের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে উত্থান হয়েছিল নতুন এক সভ্যতার। যে সভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আলোকিত করেছে এই নশ্বর পৃথিবীকে। সুতরাং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই পাহাড়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

জাবালে নুরের চূড়ায় আধঘণ্টার মতো জিরিয়ে নিচে নামতে লাগলাম। নিচে নামতে মাত্র ১৫-২০ মিনিট সময় লাগলো। তবে ততক্ষণে বেলা বেশ চড়ে গেছে। ঠা ঠা রোদে মাথা পাতা দায়। সিঁড়িগুলো বেশ ডেঞ্জারাস। ছোট এবং সরু, একটু এদিক সেদিক হলে পা ফসকে একদম পগারপার। সাবধানে নেমে এলাম পাহাড়ের পাদদেশে। গলা শুকিয়ে একদম কাঠ। পা কাঁপছে। নিচেই এক পাকিস্তানি ঠান্ডার দোকান। দোকানে ঢুকে ফ্রিজ থেকে দু-তিন পদের জুস-পানীয় নিয়ে ঢক ঢক করে গলায় ঢেলে দিলাম। এয়ারকুলারের শীতলতায় খানিক জিরিয়ে শ্রান্ত শরীর নিয়ে হোটেলের পথ ধরলাম।

(তৃতীয় পর্ব আগামী সপ্তাহে)

আরও পড়ুন: কাবার তাওয়াফ ও নিজের আত্মপরিচয়ের সন্ধান