কার হাতে জামায়াতের পরবর্তী নেতৃত্ব

জামায়াতের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে ‘আমির’ পদটি শূন্য হলেও গঠনতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ছে না জামায়াতে ইসলামী। ২০১৫ সালের জুনে গঠনতন্ত্রের সর্বশেষ সংশোধিত নিয়মে আমির নির্বাচনে ‘অনির্দিষ্টকাল’ পাশ করিয়ে নেওয়ায় রুকন সম্মেলনের আগ পর্যন্ত ‘ভারপ্রাপ্ত আমির’ দিয়েই দল পরিচালনা করবে জামায়াত। পরবর্তীতে সম্মেলনের পরিবেশ তৈরি হলে আমির নির্বাচন চূড়ান্ত করবে দলটি। এক্ষেত্রে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদকে এগিয়ে রাখছেন জামায়াতসংশ্লিষ্টরা। বয়স, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা মিলিয়ে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকলে তিনিই হবেন বাংলাদেশ জামায়াতের নির্বাচিত তৃতীয় আমির।

জামায়াতসূত্রে জানা গেছে, নতুন আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে উপযুক্ত পরিবেশ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা দলটির নেই। সরকারের ক্রমাগত চাপে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি প্রথম সারির চার নেতার ফাঁসি হয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। এ পরিস্থিতি বিগত ২০১১ সালের পর থেকে বিরাজ করছে। একে একে প্রথম সারির সব নেতারাই গ্রেফতার হন। এতে করে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল পদ নিয়ে নানা জটিলতার কারণে সর্বশেষ গত বছরের জুনে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নেয় জামায়াত।

আরও পড়ুন:  ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকফেসবুক লাইভে যা বললেন মেয়র আনিসুল হক

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জামায়াতে ইসলামীর আমির নির্বাচনের সময়সীমা ৩ বছর। দলের আগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছয় মাসের বেশি সময় দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে নতুন আমির নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা ছিল। গত বছরের জুনে প্রকাশিত গঠনতন্ত্রের সর্বশেষ সংস্করণে এ বাধ্যবাধকতা বাতিল করা হয়েছে। গঠনতন্ত্রের ৫৯তম সংস্করণের ধারা ১৫ এর ৬ এর (ঘ) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বিবেচনায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে  জামায়াতের আমির নির্বাচন অনুষ্ঠান যদি কিছুতেই সম্ভব না হয়, তাহা হলে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত আমির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার অনুমোদন সাপেক্ষে  স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। একই গঠনতন্ত্রের ২৩ (৭) ধারা অনুযায়ী, কর্মপরিষদ মজলিসে শূরার বিকল্প হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই পরিষদের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের এখতিয়ার নেই। ফলে, রুকন সম্মেলনের বাইরে নতুন আমির নির্বাচনের সমূহ সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত আমিরের নেতৃত্বেই অনির্দিষ্টকাল দল পরিচালনা করবে জামায়াত।’

গঠনতন্ত্রের অনুমোদিত এই ‘অনির্দিষ্টকাল’কেই যথাসময় হিসেবে বিবেচনা করছে জামায়াত। এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যাপক তাসনীম আলম বলেন, সংগঠনের গঠনতন্ত্র মোতাবেকই যথাসময়ে আমীরে জামায়াতের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং আমীরে জামায়াত সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগ করবেন। সুতরাং এ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কোনও অবকাশ নেই।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দল পরিচালনায় কোনও সমস্যা তৈরি হলে বা নেতাকর্মীদের চাপ থাকলে পরিবেশ প্রতিকূল হলেও রুকন সম্মেলনের বিশেষ ব্যবস্থা করবে জামায়াত। এক্ষেত্রে  ‘মেইল বা খামে’ গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তিনজনের প্যানেল থেকে আমির নির্বাচন করা হবে। তবে ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় এক প্রচার সম্পাদক বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দাবি করেছেন, নতুন আমির নির্বাচনের সম্ভাবনা এখন একেবারেই কম। আমির নির্বাচনের কোনও বাস্তবতাই এখন নেই। বৃহস্পতিবার রাতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বর্তমানে জামায়াতের রাজনীতি পর্যবেক্ষণে থাকা এ নেতা আরও মনে করেন, বতর্মান নেতৃত্ব নিয়ে জামায়াতের কোনও সমস্যা নেই। দলের অভ্যন্তরেও কোনও কাজে ব্যাঘাত ঘটেনি। দ্বিতীয় কথা, আমির নির্বাচনের জন্য সম্মেলন প্রয়োজন, এর তো ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই।

আরও পড়ুন:  বিকাশ স্বরূপজঙ্গিরা জাল বিছাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই

আমির পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য নুরুল ইসলাম বুলবুলের ঘনিষ্ট এক কর্মীও। বৃহস্পতিবার রাতে এ প্রতিবেদককে বলেন, এখন পর্যন্ত আমির নির্বাচনের ব্যাপারে কোনও কিছুই জানি না। এ অবস্থায় কী  রুকন সম্মেলন করা সম্ভব?

জামায়াত সূত্র জানায়, আমির নির্বাচনের জন্য তিনজনের প্যানেল দেওয়ার নিয়ম রয়েছে জামায়াতে। এই তিনজন থেকেই আমির নির্বাচন করবেন সারাদেশের রুকনরা। তবে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদকেই প্রথম পছন্দ দলের এই মুহূর্তের নীতিনির্ধারকদেরও। এর বাইরে সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান আছেন। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের নাম শোনা গেলেও তার সম্ভাবনা অনেক কম বলে মনে করেন কর্মী-সমর্থকরা। সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে ডা. শফিকুর রহমানের পরিবর্তনের সম্ভাবনা আপাতত কম। এর বাইরে নতুন নায়েবে আমির ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ, মিয়া গোলাম মুহাম্মদ পরওয়ার, অধ্যাপক তাসনীম আলম, ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, মাওলানা আবদুল হালিম, নুরুল ইসলাম বুলবুল  উল্লেখযোগ্য।

জামায়াতের নায়েবে আমিরদের মধ্যে অধ্যাপক একে এম নাজির আহমাদ মারা গেছেন। যাবজ্জীবন  কারাদণ্ড ভোগ করছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। গত ৯ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি অবস্থান মারা যান নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসূফ। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন  সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সোবহান। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম ও মীর কাসেম আলী কারাবন্দি। বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক।

আরও পড়ুন:  মতিউর রহমান নিজামীনিজামীর জানাজা নিয়ে ‘জনপ্রিয়তা’র প্রচারণা!

জানতে চাইলে জামায়াতের কোনও দায়িত্বশীলকেই পাওয়া যায়নি।  তবে মাসদুয়েক আগে দলটির নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এ প্রতিবেদকে বলেছিলেন, কেন্দ্রের নির্বাচন তো তিন বছর পর পর। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়েছে। তবে শিগগিরই নতুন কমিটির কোনও সম্ভাবনা নেই।’

জামায়াতের সুহৃদ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা ড. খলিলুর রহমান মাদানীর ধারণাপ্রসূত মন্তব্য, ‘আমার মনে হয় দ্রুতই নতুন আমির নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কম। বর্তমানে যারা আছেন, তাদের দিয়েই তো চলছে ৫ বছর। তাছাড়া দলের সাংগঠনিক, দাওয়াতি কার্যক্রম তো থেমে নেই।’

অন্য একটি সূত্র জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের ইস্যুটি শেষ হলে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের কাজে হাত দেবে জামায়াত। বিচার চলা অবস্থায় কোনও নেতাকে বাদ দেওয়ার অবস্থান থেকে সরে এসেছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। নীতিগত কারণেই তাই নেতৃত্ব বদল সম্ভব নয়।

এমনই আভাস মিলেছে দলটির কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ যাইনুল আবদীনের কথায়ও। তার ভাষ্য, এখন তো ভারপ্রাপ্ত দিয়েই চলছে। একই মন্তব্য করেন সিলেট জেলা দক্ষিণের আমির মাওলানা হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, আপাতত নতুন নেতৃত্বের সম্ভাবনা নেই। তবে কেন্দ্র ঠিক করবে, কী হবে।

আরও পড়ুন:  বজ্রাঘাতরাজধানীসহ সারাদেশে বজ্রাঘাতে নিহত ২৯

জামায়াতের একটি অনির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, দলটির বর্তমানে সারাদেশে ১৬ হাজার রুকন রয়েছেন। অন্য একটি সূত্র দাবি করে, এর সংখ্যা ৩৮ থেকে ৪০ হাজারের মধ্যে। দলটির সর্বশেষ রুকন সম্মেলন ২০০৯ এর ডিসেম্বরে হয়েছিল। ওই সম্মেলনে আমির নির্বাচত হয়েছিলেন মতিউর রহমান নিজামী।  এরপর ২০১০ সালের ২৯ জুন প্রেসক্লাবের সামনে থেকে ধর্মানুভূতিতে আগাতের মামলায় গ্রেফতার হন নিজামী। একই মামলায় একই দিনে গ্রেফতার হন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিবৃতিতে তাসনীম আলম বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী একটি ইসলামী সংগঠন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী  গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমান জালেম সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ও সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ষড়যন্ত্র করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। এ কারণে জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশের একটি আইনানুগ বৈধ রাজনৈতিক দল। সরকারের বাধা-বিপত্তি, জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে জামায়াত প্রকাশ্যে আইনানুগভাবে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করি, জামায়াতে ইসলামী আইনানুগভাবেই চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কাজেই জামায়াতের নাম বদল, কিংবা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করার প্রশ্নই আসে না।

এসটিএস/এপিএইচ/