এ সপ্তাহের শুরুতে রাজনৈতিক দোলাচলের মধ্যে মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) গুলশানের একটি হোটেলে দেশীয় রাজনীতিক ও বিদেশি দূতাবাসগুলোর প্রতিনিধিদের সামনে ‘১০ ডিসেম্বর নিয়ে কোনও দ্বিধা রাখবেন না মনে, ১০ ডিসেম্বর অবশ্যই ঢাকায় সমাবেশ হবে’—শীর্ষক বক্তব্য দেওয়ার দুদিন পরই গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মির্জা ফখরুল যখন রাজধানীর ডিবি অফিসে ৮ ঘণ্টার আটকাবস্থায় সময় পার করছিলেন, সে সময়েই শনিবারের সমাবেশের অনুমতি পায় বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের শারীরিক অনুপস্থিতিতে যিনি ইতোমধ্যে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সমাবেশের আগের দিন রাতে তার গ্রেফতারে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ, চুলচেরা বিশ্লেষণ।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে—তারা মৌলিকভাবে মনে করেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দিতে ও চলমান সমাবেশের পরিকল্পিত, সমন্বিত কার্যক্রম নস্যাৎ করতেই মামলা দিয়ে মির্জা ফখরুলকে গ্রেফতার করানো হয়েছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু মনে করেন, সমাবেশে লোক কমানোর লক্ষ্যেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওরা মনে করেছে—তাদের গ্রেফতার করলে লোক কম হবে। লোক কমানো ওদের উদ্দেশ্য।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই মনে করেন, মির্জা ফখরুল বিএনপির সবচেয়ে সক্রিয় মহাসচিব। সর্বশেষ গত বুধবার পুলিশের হামলার মধ্যে যেভাবে একা দাঁড়িয়েছেন নয়া পল্টনে, রাজনীতিতে তার ভাবমূর্তি এতে আরও উজ্জ্বল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ লাভ করেছে।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে উত্তরার বাসা থেকে গোয়েন্দারা মির্জা ফখরুলকে নিয়ে আসার পর বেইলি রোডের ডিবি অফিসেই ছিলেন তিনি। সেখানে সকালে নাস্তা করেন। এরপর দুপুরে ডিবি অফিসে দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন। পুরো সময়টিতেই তিনি মানসিকভাবে শক্ত ছিলেন বলে জানান বিএনপি চেয়ারপারসন মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান।
শুক্রবার রাতে শায়রুল কবির খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি পরিবার ও আইনজীবীর মাধ্যমে খবর পেয়েছি, তিনি সকালে ডিবিতে নাস্তা করেছেন। এরপর দুপুরে হালকা খেয়ে কোর্টে যান। সেখান থেকে মির্জা আব্বাসসহ তাকে কারাগারে নেওয়া হয়। তিনি যাওয়ার সময় যারা ছিলেন তাদের উচ্চ সাহস দিয়ে গেছেন। খুব সাহসিকতার সঙ্গে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। অনেকের কথাও জানতে চেয়েছেন।’
বিএনপির প্রভাবশালী ও নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, মির্জা ফখরুল গ্রেফতারের হিসাব-নিকাশে দলের ভেতরে ও সরকারের মধ্যে সমন্বিতভাবে একটি পক্ষ কাজ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষত, দলের ভেতরে ঈর্ষান্বিত পক্ষটি তার গ্রেফতারে অণুঘটক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে— এমন আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ।
কেউ কেউ মনে করেন, এই মুহূর্তে বিএনপির নেতৃত্বে সরাসরি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন মির্জা ফখরুল। সর্বশেষ ১২ অক্টোবর থেকে দেশব্যাপী ৯টি সমাবেশে তার উপস্থিতি ও রাজনৈতিক বক্তব্য ডিমান্ড করছিল ঢাকায় এসে তিনি বার্তা দেবেন।
বিএনপির প্রভাবশালী একজন দায়িত্বশীল বলছেন, মির্জা ফখরুল দলের মহাসচিব হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে কতখানি সক্রিয় ও সাবলীল ছিলেন—সেটা এখন তার কারাগারে থাকার সময়টিতে স্পষ্ট হবে।
মির্জা ফখরুল ২০১১ সালের ২০ মার্চ থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পান। এরপর ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ কাউন্সিলের পর তিনি সপ্তম মহাসচিব হিসেবে নিয়োজিত। এর আগে, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বরে পঞ্চম সম্মেলনে তিনি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে নিযুক্ত হন।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উদার, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক যে ঐক্য ও যুগপৎ আন্দোলনের সমন্বিত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা যেন মির্জা ফখরুলের অনুপস্থিতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে না পড়ে।’
যদিও এই আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন স্থায়ী কমিটির একনেতা। তার ভাষ্য, বিএনপি এখন জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে। এখানে অন্য কিছুর জায়গা নেই।
মির্জা ফখরুলের ভারপ্রাপ্ত কি নিয়োগ হবে?
শুক্রবার গ্রেফতারের খবরে রাজনীতিতে মির্জা ফখরুলের অনুপস্থিতিতে ‘ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব’ হিসেবে কাউকে দেওয়া হবে কিনা, এ নিয়ে আলোচনা চলেছে। যদিও স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘দলে এখনও এ চিন্তার জায়গা নেই। তিনি সবচেয়ে ভালো সেক্রেটারি জেনারেল। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এসব সিদ্ধান্ত নেবেন।’
আরও পড়ুন:
একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: আমরা যুদ্ধ করতে চাই না