আবারও অন্ধকারে বাংলাদেশের ক্রিকেট!

519A9910স্টেডিয়ামের উত্তর দিক চা-বাগানে ঘেরা। হয়তো সেজন্য একপাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। সময় ‍যত গড়িয়েছে, কুয়াশা তত ঘন হয়েছে। অনেকটা বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের মতো। অথচ টাইগারদের সামনে সুযোগ ছিল, শেষ ম্যাচ জিতে ‘কুয়াশা’ ভেদ করে আলোর ঝলকানি দেখানোর। দীর্ঘ চার বছর অপেক্ষায় ছিলেন সিলেটের ক্রিকেট-ভক্তরা। কিন্তু সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টাইগারদের প্রথম ম্যাচ শুধু হতাশই করেছে সিলেট সহ সারা দেশের মানুষকে।

‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’–প্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। দুই সপ্তাহ পর ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ যাবে শ্রীলঙ্কায়। জয়ের সৌরভ নিয়ে লঙ্কানদের মাটিতে পা রাখতে পারলে নিশ্চয়ই ভালো হতো। কিন্তু তা আর হলো কই! হতাশা ভরা সিরিজের শেষটাও হলো ব্যর্থতায়। প্রথম টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের সর্বোচ্চ ১৯৩ রান করেও হার মেনেছে ৬ উইকেটে। দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচে পরাস্ত হলো ৭৫ রানে।

বাংলাদেশের ক্রিকেট কি ঠিক পথে আছে? ব্যর্থতার সিরিজ শেষে প্রশ্নটা উঠছেই। এমন একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের সম্মানজনক হারই প্রত্যাশিত ছিল সবার কাছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিশ্বের প্রায় সব বড় দলকে হারিয়ে সত্যিকারের ‘টাইগার’ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ঘরের মাঠে মাশরাফি-সাকিব-তামিমদের পারফরম্যান্স দুর্দান্ত। অথচ এবার স্বাগতিক হয়েও ব্যর্থতার বৃত্তেই আটকে থাকলো। কী হলো বাংলাদেশের? চন্ডিকা হাথুরুসিংহে চলে যাওয়ার ধাক্কা সামলে উঠতে পারছে না? নাকি অন্য কিছু! প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারও।

নিজেদের শহরে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ নিয়ে ভীষণ রোমাঞ্চিত ছিল সিলেটবাসী। খেলা শুরু বিকেল পাঁচটায়, কিন্তু দুপুর থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল স্টেডিয়ামের পথে। টিকিট অনেক আগেই শেষ, তবু প্রিয় দলের খেলা মাঠে বসে দেখার আশায় স্টেডিয়ামের মূল গেটের সামনে অনেকেই দাঁড়িয়েছিলেন। যারা মাঠে ঢুকেছিলেন, তাদেরও অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে টিকিট পেতে হয়েছিল। সেসব ভক্তের কষ্টের প্রতিদান দিতে পারেনি টাইগাররা।

অষ্টম ওভারে তামিম ইকবাল ছক্কা মারতে গিয়ে লং-অনে ধরা পড়লে খালি হতে থাকে পশ্চিম দিকের গ্যালারি। এরপর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ আর তরুণ অলরাউন্ডার সাইফউদ্দিন চেষ্টা করলেও লক্ষ্যের কাছাকাছিও যেতে পারেনি বাংলাদেশ।  

ঢাকায় প্রথম ম্যাচ হেরে যাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদউল্লাহ বলেছিলেন, কোনও বিভাগেই তারা একসঙ্গে জ্বলে উঠতে পারেনি। প্রতি ম্যাচেই কোনও না কোনও বিভাগের ব্যর্থতা তাদের ভুগিয়েছে। আজ অবশ্য তিন বিভাগই ছিল ব্যর্থ। এলোমেলো বোলিং, নিম্ন মানের ফিল্ডিং (ক্যাচ পড়েছে তিনটি) আর বাজে ব্যাটিংয়ের মাশুল দিয়ে বিশাল হারের লজ্জায় পড়েছে স্বাগতিক দল।

একটা ‘রেকর্ড’ অবশ্য করেছে বাংলাদেশ, লজ্জার রেকর্ড! ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ছয়টি ম্যাচ আয়োজন করেছিল সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এতদিন এখানে সর্বোচ্চ রান ছিল নেদারল্যান্ডসের ১৯৩, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। আজ সেটাকে দুই নম্বরে নামিয়ে শ্রীলঙ্কা করলো ২১০ রান।

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ছিল না কখনও। তবে তাদের ব্যাটিং অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে প্রশ্ন ছিল, আছে আর ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে! আজ আবার তারা প্রশ্নটা রাখলেন সবার সামনে। কোন বল মারতে হবে আর কোনটা ছাড়তে হবে সেটা নিয়ে যেন দ্বিধায় পড়ে যান বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। তাই ব্যাটিং সহায়ক উইকেটেও স্বাগতিকরা ১৩৫ রানে অলআউট, ৮ বল আগেই।

সন্ধ্যার পর শিশির পড়ে বলে টস জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। সিদ্ধান্তটা অযৌক্তিক নয়, কিন্তু বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ককে শুরু থেকেই হতাশ করেছেন বোলাররা। তাদের নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে উঠে বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করিয়েছে অতিথিরা, আর কঠিন লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে বাংলাদেশ।  

সিলেটে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচে ‘ঘরের ছেলে’ রাহীরও অভিষেক হয়েছে। প্রথম ওভারেই মাহমুদউল্লাহ এই তরুণ পেসারের হাতে বল তুলে দিলে উল্লাসে ফেটে পড়ে গ্যালারি। কিন্তু অভিষেক ম্যাচে রাহী ব্যর্থ। অবশ্য শুধু রাহী নয়, মোস্তাফিজ-সাইফউদ্দিন-মেহেদী হাসান সবাই ব্যর্থ। বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপু ছাড়া আর কেউ লাইন-লেন্থ ঠিক রেখে বল করতে পারেননি। অনেক ফুলটস আর শর্ট বল ‘উপহার’ দিয়েছেন তারা প্রতিপক্ষকে। অতিথিরা যার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে রানের পাহাড় গড়েছে।

সিলেটের ক্রিকেট-ভক্তরা অনেকদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলেন বাংলাদেশের একটি ম্যাচের। নিশ্চয়ই এমন ম্যাচের সাক্ষী হতে তারা চাননি। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে রাহী ফিরে যাওয়ার পর মুখ চেপে ধরলেন একজন। তার হতাশা ভরা অভিব্যক্তিতেই যেন ফুটে উঠলো বাংলাদেশের ব্যর্থতার চিত্র।

শ্রীলঙ্কা দল বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার আগেই হাথুরুসিংহেকে নিয়ে শুরু হয়ে যায় মাতামাতি। যেন শ্রীলঙ্কা নয়, প্রতিপক্ষ হাথুরুসিংহে। তাতেই হয়তো ফোকাস নড়ে গেছে খেলোয়াড়দের। সাবেক গুরুকে জবাব দিতে গিয়ে উল্টো তারাই পড়ে গেছেন ব্যর্থতার চোরাবালিতে। হতাশার সিরিজ শেষে হাথুরুসিংহে অবশ্য পরম বন্ধুর ভূমিকায়। নিজেই গিয়ে কথা বললেন তামিম-মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে, বুকে জড়িয়ে ধরলেন তামিমকে। তামিম হয়তো তখন বলছিলেন, ‘তুমিই দেখিয়ে দিলে গুরু!’

দিনের শেষে এটা শুধুই একটা খেলা। আর খেলায় হার-জিত থাকবেই। কিন্তু ঘরের মাঠে বাংলাদেশ যেভাবে আত্মসমর্পণ করলো, তা অবশ্যই বিস্ময়কর। অন্ধকার দিন পেছনে ফেলে আলোয় উদ্ভাসিত বাংলাদেশের ক্রিকেট কি আবার অন্ধকারে ফিরে যাচ্ছে? প্রশ্নটার উত্তর খোঁজা জরুরি।