সবরমতির ‘নীল জলে’ উঠলো না ঢেউ

সুদৃশ্য ট্রফি নিয়ে শচীন টেন্ডুলকার মাঠে প্রবেশ করতেই নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকের যেন আনন্দের সীমা নেই। কালো সানগ্লাসে এই কিংবদন্তি ছিলেন বেশ হাস্যোজ্জ্বল। উত্তরসূরি রোহিত-কোহলিদের ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। ২০১১ সালের পর আবারও যে নিজেদের মাঠে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের হাতছানি। ফাইনালের আগ পর্যন্ত দারুণভাবে চলা দলটির প্রত্যেকে যে শুধু শচীন নয়, সবার মধ্যে বড় স্বপ্নের বীজটা ভালোভাবে বুনে দিয়েছিল। 

কিন্তু ঘুণাক্ষরে হয়তো শচীন কিংবা মাঠে আসা লক্ষাধিক সমর্থকরা বুঝতে পারেননি ম্যাচ শেষে হৃদয় ভাঙার দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে তাদের, তৃতীয় ট্রফি জয়ের স্বপ্ন এভাবে গুড়েবালি হবে! মুম্বাইয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে শচীন-কোহলিরা ট্রফি হাতে উল্লাস করতে পেরেছিলেন। আর এবার শহরঘেষা সবরমতি নদীর 'নীল জলে' ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং সলিল সমাধি হলো সব স্বপ্নের! 

খেলা দেখে মনে হয়েছে লক্ষাধিক নীল সমর্থকের চাপটা রোহিত-কোহলিরা ঠিকঠাক সহ্য করতে পারেননি। নয়তো এমন পিচে কোনও দল ২৪১ রানের মামুলি টার্গেট দেয়! তাও আবার প্রতিপক্ষ যখন পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। রোহিতরা আগের মতো দায়িত্ব নিয়ে খেলতে পারলে হয়তো বড় ইনিংস গড়ার সুযোগ ছিল।

ফাইনালের আগে কোনও ম্যাচেই ভারত অলআউট হয়নি। এবার কিনা ইনিংসের শেষ বলে তাও হতে হয়েছে। এরই মধ্যে কোহলি-রোহিত চলমান বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ইনিংস গড়ে ফেলেছেন। কোহলি তো ৭৬৫ রান করে ১৩ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের খাতায় নাম তুলেছেন। রোহিতও কম যাননি। ৫৯৭ রান করে এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় হওয়ার পাশাপাশি সব মিলিয়ে অধিনায়ক হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

রেকর্ড যাই হোক না কেন। ২৪১ রান অতিক্রম করতে অস্ট্রেলিয়ার কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়নি। শুরুতে ওয়ার্নার, স্মিথ ও মার্শ আউট হলে গ্যালারিতে আনন্দের ঢেউ উঠেছিল, কিন্তু অজিরা বুঝি ১৯৯৬ সালে জেতা শ্রীলঙ্কার  ফাইনালকে অনুসরণ করেছে! 

তবে সেবার অজিদের হতাশ হতে হয়েছিল। তাদের ২৪১ রান অনুসরণ করতে গিয়ে তিন উইকেট পরে যায় শ্রীলঙ্কার। অরবিন্দ ডি সিলভার সেঞ্চুরিতে ট্রফি জয় নিশ্চিত হয়, হেরে যায় অজিরা।
আর আজ অস্ট্রেলিয়া হারেনি, জিতলো ট্র্যাভিস হেডের অসাধারণ এক সেঞ্চুরিতে। হেড ১৫ টি চার ও ৪টি ছয়ে ১৩৭ রান করেন। অন্য প্রান্তে ধৈর্য ধরে ১১০ বলে ৫৮ রান করে ক্রিজে ছিলেন  লাবুশেন।

আগের ম্যাচে দারুণ বল করা মোহাম্মদ শামিও এবার পারেননি ঝলক দেখাতে। বুমরা-জাদেজারও একই অবস্থা। 

নিজের নামে নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসেছিলেন। এসেছিলেন বলিউড বাদশা শাহরুখ খান থেকে শুরু করে অনেক সেলেব্রিটি। রণবির সিং তো নানাভাবে দলকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি নীল জার্সি পরে লাখো সমর্থকরা তো ছিলেনই। যাদের মাঝে গুটিকয়েক হলুদ জার্সিধারীদের খুঁজে নেওয়া ছিল দুষ্কর।

শেষ পর্যন্ত নীল জার্সিধারীদের মাঝে 'মিনোস' হলুদ জার্সিধারীরা উল্লাস করেছে। সব বিভাগে দারুণ সাফল্যের ছাপ রেখে স্বাগতিকদের স্বপ্ন গুড়েবালি করে দিয়েছে।

রোহিত টি-টোয়েন্টির শিরোপা জিতলেও ওয়ানডের ট্রফি অধরা থেকে গেলো। কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের জন্য জিততে চাইলেও সেটাও হলো না। অস্ট্রেলিয়া ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জিতে 'হেক্সা মিশন' পূর্ণ  করলো। অদূর ভবিষ্যতে অজিদের টপকে যাওয়ার সম্ভাবনাও সেভাবে কোনও দলের নেই। কাছাকাছি ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুটো শিরোপা নিয়ে অনেক পেছনে।

আজ আহমেদাবাদে কিছুটা দূরত্ব ঘোচানোর সুযোগ হারিয়ে সবরমতি নদীতে সবকিছুই যেন বিসর্জন দিতে হলো রোহিতদের। এই দুঃখ থাকবে ২০২৭ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। 

পুরস্কার নেওয়ার আগে মাঠে শচীনকে দেখে মনে হচ্ছিল সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তাদের বিষাদের দিনে ট্রফি হাতে অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের আনন্দ উল্লাসের দৃশ্য যেন এক একটা শেল হয়ে বিঁধছিল। এর পরে অন্ধকার আকাশ ফুঁড়ে আতশবাজির আলো কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

এমন আশা ভঙ্গের ফাইনাল যে ভারত চায়নি!